দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে সবথেকে প্রাঞ্জল এবং মর্মস্পর্শী সংকলন খুব সম্ভবত মেজর মোঃ দেলোয়ার হোসেন ( Del H Khan) সম্পাদিত বইটিই। বইমেলায় হট্টগোলে হারিয়ে যাওয়া কিছু বইয়ের তালিকায় এটা ছিল না। আলাদাভাবে হাতে করে ক্যাম্পাসে নিয়ে রেখেছিলাম। পড়াও শেষ হয়েছিল বেশ কিছু দিন আগে। তবে এই বই নিয়ে দুই কলম লেখা আর হয়ে ওঠেনি।
বেস্ট সেলার ইতিহাসবই, কথাটা শুনলেই অনেকে চমকে ওঠেন; তাও আর বাংলাদেশে। এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন মেজর দেলোয়ার। তাঁর আধুনিক দৃষ্টিকোণে সান জু-রঃ দ্য আর্ট আব ওয়ার বইটি পড়ার পর সত্যিই অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। সেনা সদস্য হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা আর আগ্রহী পাঠক হিসেবে তার নিজের চিন্তা এ দুটোর সমন্বয় না ঘটলে অমন গ্রন্থ লেখা সম্ভব হতো না। মূলত সেই আগ্রহ থেকেই যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শীর্ষক সংকলন হাতে নিলাম প্রথমত, কিছুটা থমকে যেতে হয়েছিল।
বলে নেয়া ভালো, এটা তাঁর নিজের লেখা নয়; বরঞ্চ সংকলন। নিজে একটা বই লিখে দেয়ার জন্য জ্ঞান, আগ্রহ আর প্রজ্ঞার প্রয়োজন হয়। কিন্তু অন্যের লেখাকে টেনে এনে জড়ো করে তার মেইনস্ট্রিমিং এর জন্য লাগে সীমাহীন ধৈর্য আর আন্তরিকতা। সেদিক থেকে এই বইটিকে এগিয়ে রাখতে হয়। তবে সংকলিত বই হলে যেমন হয়, এখানেও সে দুর্বলতা প্রণিধানযোগ্য। বিশেষ করে কোনো একটা লেখাকে খুব ভাল লাগার ঠিক পরেই আরেকটি লেখাস পড়তে গেলে বিরক্তির উদ্রেক করে। আর এই সব সম্ভাবনাকে যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনার জন্য লেখক সাধুবাদ পেতে পারেন।
ব্লিজক্রিগের ঘেরাটোপে পোল্যান্ডের পরাজয় থেকেই জার্মানির ভেলকিবাজি শুরু। অন্তত রাশিয়ার ভূখণ্ড আর প্রকৃতির মুখোমুখি হয়েই পরাজিত হয়েছিল জার্মানরা, নাহলে তাদের থামায় সাধ্য কার? এই নির্মম সত্য কোনো লেখক স্বীকার করতে চান না। কিন্তু বর্তমান গ্রন্থের বর্ণনায় স্বীকার করা হোক না হোক এই বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো অভিপ্রায় অন্তত সম্পাদক কিংবা লেখকের মাঝে লক্ষ করিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বেশ কয়েকজন বীরযোদ্ধা এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে গল্প সংকলন হিসেব বইটি প্রকাশ করা হলেও তা ইতিহাস থেকে একেবারে বিযুক্ত নয়। আমি মনে করি এখানেই বইটিই সফলতা। আমার হিসেবে এই সংকলনের সেরা লেখাটি প্রিয় ছোট ভাই Muhaiminul Islam Antik এর অনূদিত। অন্যদিকে মনিকা রহমানের অনুবাদে আ নাইট টু রিমেম্বারের ভাষা বেশ সাবলীল। তবে একই অনুবাদকের দ্য পাসওয়ার্ড ওয়াজ মান্দালয় অপেক্ষাকৃত জটিল এবং প্রায় দুর্বোধ্য। খুব সম্ভবত আক্ষরিক অনুবাদের প্রচেষ্টা কিংবা বিষয়ভীতি থেকে এমনটা হতে পারে। তবে একই অনুবাদকের অন্য কয়েকটা লেখা আশাতীত রকমের সাবলীল।
আ ডে অব সুইপিং মাইন অব ডোভার শীর্ষক লেখাটার বেশ পাঠযোগ্য অনুবাদ করেছেন রাফায়েত আলভি। হোয়েন হিটলার ইনভেডেড আমেরিকা শীর্ষক লেখাটার অনুবাদ আরও চমৎকার হতে পারতো। অন্তত এই লেখার গল্পগুলোর বেশ কয়েকটি আমার আগে থেকে পড়া থাকায় আরেকটু প্রাঞ্জল অনুবাদ ও সাবলীল বর্ণনা প্রতাশ্যা করেছিলাম যা একমাত্র মুহাইমিনুল ইসলাম এবং মনিকা রহমানের একটি অনুবাদে পাওয়া গেছে।
সব লেখার শেষে অবশ্যই দুর্দান্ত বলা যায় বইটির উপসংহার। নানাবিধ দুর্বলতা, জটিলতা ও দুর্বোধ্যতা এখানে এসে শেষ হয়েছে মেজর দেলোয়ারের লেখকসুলভ বর্ণনায়। ক্ষেত্রেবিশেষে কালো হরফের পরিভ্রমনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ঘুরে আসার অনুভূতি পাবেন আপনি। অন্তত ইতিহাসপ্রিয় পাঠকের উচিত বইটি পড়ে নেয়া। অনুবাদের কিঞ্চিত দুর্বলতা বাদ দিলে বইটা সত্যিই মনের খোরাক মেটানোর মতো নন-ফিকশন।