
শেষ পর্যন্ত সে তার দাবির পক্ষে নিয়ে আসে তার মাকে। হাসান চেয়েছিলেন, তার ছেলে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করুক, সে আরেকটু বড় হয়ে উঠুক। তবে তার স্ত্রী তাকে বোঝালেন যে, নিয়ে গেলেই তো আর তার ছেলের চাকরি হয়ে যাচ্ছে না। উপরন্তু ছেলের এ অনুরোধও রক্ষা যাবে। শেষ পর্যন্ত হাসান খান অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্ত্রী ও ছেলের মন রাখার চেষ্টা করেন। তিনি ফরিদকে মসনদ-ই-আলা উমর খানের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। উমর খান এইটুকু ছেলের কর্মস্পৃহা দেখে অবাক হন। পাশাপাশি বলেন, তোমার এখনও কাজের বয়স হয়নি। তবু তাকে উৎসাহিত করার জন্য তাকে শাহবাদ পরগনার শাহওয়ালী গ্রামের একটি ছোট্ট পল্লীর দেখভালের দায়িত্ব দেয়া হয়। এই গ্রামের দায়িত্বভার গ্রহণের পর শৈশব থেকেই তিনি যে দক্ষতা দেখিয়েছিলেন তার থেকে অনেকে অনুমান করেছিল এক উজ্জ্বল ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে ফরিদের জন্য। তবে তার ভাগ্য অতটা সুপ্রসন্ন ছিল না। শৈশব থেকে শুরু করে জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে।
প্রসঙ্গত বলে রাখা যায়, পরবর্তীকালের ফরিদের বাবা হাসান খানের ছিল চার স্ত্রী। এদিকে সব মিলিয়ে হাসান খানের আট ছেলে ছিল। তাদের মধ্যে ফরিদ ও নিজামের মা ছিলেন এক আফগান নারী। আলী ও ইউসুফের মা ছিলেন আরেকজন। এদিকে খুররম ও সাদি খানের মা ছিলেন হাসান খানের তৃতীয় স্ত্রী। তবে প্রভাবশালী ছিলেন তার চতুর্থ স্ত্রী, যিনি সুলায়মান ও আহমদের মা। প্রথম স্ত্রী হিসেবে শেষ দিকে ফরিদ ও নিজামের মায়ের তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না হাসান খানের কাছে। কিছু কুস্বভাবের কারণে তাকে একদম পছন্দ করতেন না তার প্রথম স্ত্রী। পাশাপাশি তার ন্যায়-অন্যায় সবকিছুর বেশ গুরুত্ব ছিল চতুর্থ স্ত্রী তথা সুলায়মান ও আহমদের মায়ের কাছে। একটা পর্যায়ে এসে দেখা যায়, অনেকটা চতুর্থ স্ত্রীর বশংবদে পরিণত হয়েছে হাসান খান। এর পরিণতিতে চিরবিদ্রোহী ফরিদের সঙ্গে বাবার সঙ্গে বেশ তিক্ততা সৃষ্টি হয়। বাবার আচরণে বিরক্ত ফরিদ প্রায়ই হাসান খানের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হতেন। সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য হওয়ার পরও ফরিদের বাবা তাকে উপযুক্ত জায়গির প্রদান করেননি। তাই তিনি নিজের বাবার ওপর বিরক্ত হয়েই সোজা জামাল খানের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
এভাবে অল্প বয়সে বাড়ি ছেড়ে গিয়ে বিহারের সুলতান বাহার খা লোহানীর অধীনে চাকরি নিয়েছিলেন ফরিদ। অল্প বয়সেই তাঁর সাহস ও বীরত্বের জন্য বাহার খান তাঁকে ‘শের খান’ উপাধিতে সম্মানিত করেন। এই বাহার খানের মৃত্যু হলে তাঁর নাবালক পুত্র জালাল খানের অভিভাবকের দায়িত্ব বর্তায় শের খানের উপরেই। এ সময় তিনি বিহারের উপর কর্তৃত্ব লাভ করেন। তারপর বিয়ের মাধ্যমে সামরিক সুবিধাজনক স্থানে অবস্থিত চুনার দুর্গ অধিকারে এসেছিল তাঁর। তাঁর ক্ষমতার পাশাপাশি ধারাবাহিক সম্পদ বৃদ্ধি জালাল খানের পাশাপাশি তার দরবারের অন্য অমাত্যবর্গের সীমাহীন ঈর্ষার কারণ হয়। এদের কুপরামর্শে জালাল খান শের খানকে দমন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শের খানের আধিপত্য থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে তিনি বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। কুশলী যোদ্ধা শের খান তাদের মিলিত বাহিনীকে প্রতিহত করেন। ১৫৩৪ সালের দিকে সুরজগড়ের তীব্র যুদ্ধে মাহমুদ শাহ ও জালাল খানের সম্মিলিত বাহিনী একঅর্থে কচুকাটা হয়ে যায় শের খানের নেতৃত্বাধীন আফগান বাহিনীর কাছে।
সুরজগড়ের যুদ্ধজয় বিহারের ওপর শের খানের কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করে দেয়। এরপর ১৫৩৮ সালে আরেক দফা আক্রমণ চালিয়ে তিনি বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহকে পরাজিত করেন। তার ধারাবাহিক সাফল্যে চিন্তিত হয়ে পড়ে দিল্লি মোগলরা। একটা পর্যায়ে মোগল সম্রাট হুমায়ুন বাংলা অভিমুখে এগিয়ে আসেন। তাঁর অগ্রসর হওয়ার সংবাদ পেয়ে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে তখনকার মত বাংলা ছেড়ে পালিয়ে যান শের খান। এর পরে আরও কয়েক দফা মোগল-আফগান ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। অবশেষে ১৫৩৯ সালে বক্সারের কাছাকাছি চৌসার যুদ্ধে তার কাছে পরাজিত হন সম্রাট হুমায়ুন। এই যুদ্ধজয়ের পর তিনি নামের পাশে ‘শাহ’ উপাধি যুক্ত করে সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এরপর তার সেনাদল বাংলা পুনর্দখল করে খিজির খানকে শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়। পরের বছর ধারাবাহিক কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত করে সম্রাট হুমায়ুুনকে তিনি ভারতের মাটি থেকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। হুমায়ুনের এই পরাজয় বলতে গেলে দীর্ঘদিনের মোগল শাসনের ক্ষেত্রে মাত্র পাঁচ বছরের জন্য একটি ছন্দপতন।
দীর্ঘদিনের মোগল শাসনের ফাঁকে মাত্র পাঁচ বছরের জন্য সম্রাট হয়েছিলেন শের শাহ। তবে এই অল্প সময়েই তিনি সাম্রাজ্যের শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি অবিন্যস্ত ও ভঙ্গুর প্রশাসনকে নানা দিক থেকে পুনর্বিন্যাস করেন। কুশলী এই সম্রাট তাঁর সাম্রাজ্যকে ৪৭টি সরকারে ভাগ করেছিলেন। পাশাপাশি তাঁর প্রতিটি সরকারকে অনেকগুলো পরগণায় ভাগ করতে দেখা যায়। নতুনভাবে বিন্যস্ত শের শাহের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় এক বাংলাতেই ১৯টি সরকার ছিল। এক্ষেত্রে প্রতিটি সরকারে ‘শিকদার-ই-শিকদারান’ তথা মুখ্য শিকদার এবং ‘মুন্সিফ-ই-মুন্সিফান’ তথা মুখ্য মুন্সিফ পদবীর দুইজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিযুক্ত হতেন। এই দুজন কর্তাব্যক্তি শিকদার, আমিন, মুন্সিফ, কারকুন, পাটোয়ারী, চৌধুরী ও মুকাদ্দাম প্রভৃতি পরগণা কর্মকর্তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতেন।
শের শাহ প্রথমবারের মত উপযুক্ত পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে ভূমি জরিপ করে উৎপাদিত ফসলের এক-চতুর্থাংশ রাজস্ব হিসেবে ধার্য করেছিলেন। তার সময়ে বিশেষ ব্যবস্থায় এই রাজস্ব নগদ অর্থে অথবা ফসলের অংশ দ্বারা পরিশোধ করার সুযোগ ছিল। তাঁর সময়েই প্রথম বারের মত ভূমি স্বত্বের দলিল তথা ‘পাট্টা’ এবং চুক্তির দলিল তথা ‘কবুলিয়াত’ প্রচলিত হয়েছিল। এই দরিল প্রথম বারের মত জমির উপর প্রজার মালিকানা সুনিশ্চিত করে। এর ফলে যেকোনো জায়গীরদার চাইলেই অন্যায়ভাবে কৃষকের জমি দখল করতে পারত না। এই ধরণের সংস্কারের পাশাপাশি কৃষিকাজে উৎসাহ দিতে ভারতবর্ষে প্রথমবারের মত সাম্রাজ্যের উদ্যোগে কৃষকদের ঋণ দানের ব্যবস্থা করেছিলেন শেরশাহ। মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কারের পাশাপাশি হয়রানিমূলক নানা ধরণের কর রহিত করে ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতির চেষ্টা চালান তিনি।
রাজ্যের যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নয়নের ক্ষেত্রেও শেরশাহের উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয়। তিনি তার সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত সব এলাকার সঙ্গে রাজধানী আগ্রার উপযুক্ত সংযোগ সড়ক তৈরি করেছিলেন। এই বিশেষ সড়কের দুইপাশে গাছ লাগানোর পাশাপাশি নির্দিষ্ট দূরত্বে সরাইখানা, মসজিদ ও মন্দির প্রতিষ্ঠার উদ্যোগটাও ছিল তাঁর। তিন হাজার মাইল দীর্ঘ বিখ্যাত সড়ক-ই-আযম তথা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড তাঁর কীর্তি। সুপ্রশস্ত এই মহাসড়ক সোনারগাঁও থেকে আগ্রা, দিল্লি ও লাহোর পার হয়ে মুলতান পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। দিল্লি ও আগ্রা থেকে সাম্রাজ্যের দুর্গম অঞ্চলে এবং বাইরে থেকে রাজধানীতে দ্রুত সরকারি নির্দেশ ও সংবাদ আদান-প্রদান নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন শেরশাহ। তিনি এই যাত্রা দ্রুত করতে পথিমধ্যে সংবাদ-বাহকের ঘোড়া বদল করার অভিনব পদ্ধতির সূচনা করেন। এক্ষেত্রে নানা স্থানে অবস্থিত সরাইখানা বার্তাবাহকের ঘোড়া বদলের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে বিচার ব্যবস্থার সংস্কার এবং জনহিতকর কাজেও তিনি ছিলেন অনন্য।
একজন কুশলী সমরনেতা, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ সম্রাট শেরশাহের জীবনের নানা দিক নিয়ে আব্বাস খান শেরওয়ানী রচনা করেন তাঁর সুবিশাল গ্রন্থ ‘তারিখ-ই-শেরশাহী’। এর বাইরে সরাসরি শেরশাহের জীবন ও কর্ম নিয়ে তেমন কোনো প্রাথমিক ঐতিহাসিক সূত্র নেই বললেই চলে। তবে শেরশাহের একজন গুণমুগ্ধ আব্বাস খান শেরওয়ানী প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ইতিহাসের মূল ঘটনা লেখার চেয়ে শেরশাহের প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। তিনি এর বাইরে তার পরিবারের অনেকের সঙ্গে শেরশাহকে সম্পৃক্ত করে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধির চেষ্টাও চালিয়েছেন নানা দিক থেকে। এর বাইরে প্রাথমিক দলিল হিসেবে ‘তারিখ-ই-শেরশাহী’ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিহার সরকারের আর্থিক সহায়তায় পাটনার কে.পি যশওয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবটি হিস্ট্রিকাল রিসার্চ সিরিজ প্রকাশ করলে সেখানে ঠাঁই পায় অমূল্য এ গ্রন্থটির অনুবাদ। আর এক্ষেত্রে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে অধ্যাপক আনন্দলাল ঠাকুরের কথা বলা যায়। গ্রন্থটি মূল ফার্সি থেকে অনুবাদ করেছেন ব্রহ্মদেব প্রসাদ আম্বাস্তিয়া। বিশাল কলেবরের এই গ্রন্থটি সরাসরি অনুবাদ করলে তা হয়ত গবেষকদের চাহিদা পূরণ করতে পারত। তবে গবেষকরা মূল ফার্সি গ্রন্থটি পাঠ করে তাঁদের প্রয়োজন মেটাতে পারবেন।
অন্যদিকে কারও প্রয়োজন হলে ফার্সি থেকে অনূদিত ইংরেজি সুবিশাল সঙ্কলনটিও দেখতে পারেন তাঁরা। এদিকে সাধারণ পাঠকের চাহিদার কথা মাথায় রেখে আব্বাস খান শেরওয়ানীর বর্ণনা থেকে অংশবিশেষ নিয়ে অনেকটা গল্প-উপন্যাসের মত করে লেখা হয়েছে ‘শেরশাহ’ গ্রন্থটি। সুবিশাল ইংরেজি অনুবাদের পুরোটা পাঠ করার পর সেখান থেকে প্রয়োজনীয় অংশ নিয়েই এ সংকলন। গ্রন্থটি পাঠকপ্রিয়তা পেলে পরিশ্রম সার্থক হবে। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি আমার শিক্ষক অধ্যাপক এ কে এম শাহনাওয়াজ স্যারের পাশাপাশি নন্দিত ইতিহাস গবেষক ইমেরিটাস অধ্যাপক এ কে এম ইয়াকুব আলী স্যারের প্রতি। পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বাংলার ইতিহাস গবেষণার ক্ষেত্রে দুই কিংবদন্তী অধ্যাপক আহমেদ হাসান দানী এবং অধ্যাপক আবদুল করিম স্যারকে যাঁদের লেখা পড়ে ইতিহাসের প্রতি আমার আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিশেষে বইটির কাজ যথাসময়ে শেষ করতে সহায়তাকারী সোহরাব ভাই, পরেশ দা এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাধ। প্রুফপাঠের কঠিন কাজটি হাসিমুখে করে দেয়ায় সবিশেষ কৃতজ্ঞতা মৃদুল ম-লকে। প্রচ্ছদের জন্য ধন্যবাদ দিতে হয় চিত্রশিল্পী রাফাত নুরকে যিনি খুব অল্পসময়ের মধ্যে সূচারুরূপে কাজটি করে দিয়েছেন। পরিশেষে বইটি প্রকাশ করতে পারায় শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি মহান আল্লাহ বাব্বুল আলামিনের দরবারে। বইটি যদি পাঠকপ্রিয়তা পায় তবেই আমাদের সবার এত পরিশ্রম সফলতার মুখ দেখবে।
আব্বাস খান শেরওয়ানির বিখ্যাত রচনা ‘তারিখ ই শেরশাহী’ অবলম্বনে ‘শের শাহ’
প্রকাশক: Dibya Prakash
লেখক: Md Adnan Arif Salim
প্রচ্ছদ: Md Rafat Nur
সংগ্রহের জন্য দিব্যপ্রকাশে সরাসরি যোগাযোগ করুন সোহরাব ভাইয়ের সঙ্গে 01711952810।
কিংবা রকমারীতেও খুঁজে দেখতে পারেন.. https://www.rokomari.com/book/author/19119
(Visited 121 times, 1 visits today)