সাময়িকভাবে জয়দেবপুর চলে আসার আগে মিরপুর ছিল আমার বসবাস। আর আদি নিবাস বলতে গেলে ঈশ্বরদী। আমি প্রাগৈতিহাসিক মানুষের রক শেল্টার, কেভ আর যাযাবর জীবনের সঙ্গে নিজের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে মেলাতে চেষ্টা করছিলাম। বিশেষ করে আমার কম্পিউটার, ট্যাব, ল্যাপটপ আর বই নিয়ে ছোটাছুটি পাথর যুগের মানুষের ছোটাছুটি ছিল তাদের হাতিয়ার নিয়ে। আমার জীবন ও জীবিকা যেমন নির্ভর করে উপরোক্ত উপকরণের উপর তেমনি তাদের শিকার ও সংগ্রহনির্ভর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ছিল হাতিয়ার।
যাযাবর জীবন থেকে স্থায়ী আবাসব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পরিবেশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছিল। এখানে ক্ষেত্রবিশেষে নানা অনুসঙ্গ যুক্ত হয় তাদের জীবনে। আমি খেয়াল করলে দেখি বাড়িতে থাকতে কিছু ছাগল ছিল যারা পেছনে ঘুর ঘুর করেছে একটা সময়। মিরপুরে আসার পর রাস্তার কয়েকটা কুকুর আর দুইটা বেড়াল ছিল তাদের আমি নিয়ম করে খাওয়াতাম। অবাক কাণ্ড এখনও সপ্তাহের যেদিন মিরপুর যাই ওদের দেখা মেলে।
মিরপুর বেড়াতে গেলে বেড়ালদুটোকে তেমন দেখি না কিন্তু কুকুর তিনটা কিভাবে টের পায় কে জানে বাস কিংবা বাইক থেকে নামার আগেই এসে হাজির। কে বলবে মাত্র কয়েকমাস আগেই এরা আমি বাসা থেকে বের হওয়ার সঙ্গে এসে হাজির হত। তারপর হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসত আমাকে। প্রতিদিন যে এদের বিস্কুট কিংবা বনরুটি দিতাম এমনও না। তবুও এরা অসম্ভব এক মায়াময়তা নিয়ে মুখে দিকে চাইতো আর লেজ নাড়তো।
সিটি কর্পোরেশনের মহতী আবর্জনাব্যবস্থাপকদের কল্যাণে জয়দেবপুরবাসী অনেকেই বাধ্য হন নিজের বাসার আবর্জনা নিজেই ভাগাড়ে গিয়ে ফেলে আসতে। এমনকি আমাকেও এই কাজটা করা লাগে নিয়মিত। ভাগাড়ে ময়লা ফেলতে গেলে কয়েকটা কুকুর পিছু নিত। তাদের টার্গেট সেখানে খাওয়ার উপযোগী কিছু যদি থাকে। আজ সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল করলাম মিরপুরের মতই দুইটা কুকুর আমার পিছু পিছু ঠিক বাসার নিচে পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল।
অভ্যাসবশত চায়ের দোকান থেকে বিস্কুট নিয়ে ওদের খাওয়ানোর সময় ভুলেই গেছি এটা মিরপুর নাকি জয়দেবপুর কোথায় আছি। এটা সেই উন্মুক্ত ঘুরে বেড়ানো ব্যাচেলর জীবন নাকি বিয়ের পর নানা নিয়মে আটকে পড়া জীবন সেটাও মনে ছিল না অনেকাংশে। মানুষের এই অভ্যাস আর সংস্কৃতি একে অন্যের পরিপূরক। আমার হিসেবে সংস্কৃতি এক রকম বস্তুগত অভ্যাস যার প্রায়োগিক বাস্তবতা অনেকাংশেই পরিবেশনির্ভর। এ পরিবেশদ্বারা মানুষ যেমন প্রভাবিত তেমনি পরিবেশও মানুষের দ্বারা নানা আঙ্গিক ও পর্যায় হতে প্রভাবিত। আর তাই যদি না হয় এত প্রাণি থাকতে প্রাথমিকপর্বে কুকুরের গৃহপালন শুরু হয়েছিল কেনো। তাইতো কুকুর যেমন অতি সহজে মানুষের আজ্ঞাবহ হয়, তেমনি কুকুরের স্বভাবঅলা মানুষকে কর্তাব্যক্তিরা খুব পছন্দ করেন ক্ষমতার অসম বণ্টনের জন্য। কারণ অন্যায় অপকর্মের সময় এরাও চুপচাপ লেজনাড়া বাদে কিছুই করে না।
সংস্কৃতি হচ্ছে তাই মানুষ যা তার মনোদৈহিক অভিযোজনের মাধ্যমে নিজের করে নেয়। সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার ব্যাখাদান নিয়ে প্রখ্যাত মার্কিন প্রত্নতাত্ত্বিক লুই বিনফোর্ডের রেফারেন্স দিয়ে [Archaeological Systematics and the Study of Culture Process, Lewis R. Binford, American Antiquity. Vol. 31, No. 2, Part 1 (Oct., 1965), pp. 203-210] আদি সমাজের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে আমি ক্লাসে এই কথাটা প্রায়ই বলি। ক্লাসের পাঠের বাইরেও ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব কতটা হৃদয়ঙ্গম করার মত বিষয় সেটা বাসায় কিংবা বাসে বসে বসে ভাবি প্রায়ই। অন্তত এই অভিযোজন বিষয়টা ইদানিং খুব ভাবাচ্ছে আমাকে।