আট বছর আগে যখন বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তখন কী ধরনের আর্থিক ও অর্থনৈতিক জগাখিচুড়ির মধ্যে পড়েছিলেন, তা আমি বেশ স্পষ্টভাবেই মনে করতে পারছি। ব্যবসা-বাণিজ্য তত দিনে বিশেষ শ্রেণীর হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে, লাখ লাখ আমেরিকান তাদের চাকরি হারাতে বসেছে, পুঁজিবাজারেও প্রত্যক্ষ করা গেছে বিশ্রী রকমের পতন। এই আর্থিক দুরবস্থা বিশ্বের আরো অনেক দেশকেও আক্রান্ত করেছিল, যা থেকে মনে করা হয়েছিল, গত সাত দশকে এমন বিশ্রী অবস্থা আর আসেনি।
বিশ্বের নানা স্থানে মন্দাভাব থাকা সত্ত্বেও বারাক ওবামা যখন ক্ষমতা ছাড়তে যাচ্ছেন, তার দেশের আর্থিক পরিস্থিতি বেশ ভালো। তিনি দেশকে এমন একটি অবস্থানে নিয়ে গেছেন, যেখানে নিজেদের আর্থিক অবস্থা তো ভালোই, অন্য দেশকেও তারা চাইলে সাহায্য করতে পারে। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অনেক মুুনাফা করছে। তারা রেকর্ড পরিমাণ চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এ সময় বিশ্বের অনেক দেশ যখন তাদের বেকারত্ব নিয়ে নাকানি-চুবানি খাচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ, যেখানে উদ্যোক্তাদের জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ আছে। এদিকে পুঁজিবাজারেও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল বেশ ভালো, যেখানে বেশ কয়েকবার তাদের সূচক একেবারে শীর্ষে উপস্থিত হয়েছিল। এতসব স্বীকৃতির বাইরে অনেক বিষয় ছিল, যেগুলো সময়ের আবর্তে ২০০৮ সালের দিকে এসে সাবেক প্রেসিডেন্টের জন্য অশান্তির কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। বিশেষ করে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির অংক নিয়ে যখন হিসাব শুরু হয়, তখন থেকে ঝামেলার সূত্রপাত। বাণিজ্যিক উন্নয়ন ও আরো নানা আনুষঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ধীরে ধীরে উন্নয়ন প্রশ্নটা স্তিমিত হয়ে আসে। বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ ব্যবস্থার সমন্বয় করে নেয়ার প্রশ্নে ধীরে ধীরে নীতিগত সমালোচনার সূত্রপাত লক্ষ করা যায়। আর উদ্ভূত নানা সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে পাঁচটি বিষয় ঘুরেফিরে এসেছে, যা ভবিষ্যতের জন্য দিকনির্দেশনামূলক হয়ে দেখা দিতে পারে।
প্রথমত. যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি কোনো চক্রাকার অবস্থানে আর টিকে থাকতে পারে না। বিশেষ করে বৈশ্বিক পর্যায়ে আর্থিক সংকট কেটে গেলে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য। আর এত দিনে যে ক্ষতি হয়েছে, সেটাকে সরাসরি চাক্রিক অবস্থানের মধ্যে নিয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই। ওই চাক্রিক অবস্থানের চেয়ে একটি ‘ভি’ আকৃতির ধ্রুপদী রীতিতেই আস্থা রাখতে চাইছে সবাই। আর অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি হিসাব করতে গেলে নীতিনির্ধারকরা এমন কিছু বিষয়ে দৃষ্টি দিতে চাইবেন, যেখানে কাঠামোগত সংস্কার বেশ জরুরি। সেই কাজ করতে গিয়ে একদিকে মূল্যবান সময় যেমন নষ্ট হয়েছে, তেমনি নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক সংকট যুক্ত হওয়ায় শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে, পুরো আর্থিক কাঠামোতেই নানা ধরনের সংকট অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে।
দ্বিতীয়ত. একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, যা আর্থিক পতন কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। চাক্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে গেলে শুরু থেকেই কিছু সতর্ক অবস্থান নিতে হয়, যা পরিস্থিতির বলি হওয়া থেকে পুরো অর্থ ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে। এর বাইরে একবার কোনোভাবে পতন দৃষ্ট হলে, তা থেকে উত্তরণের পথ করে নিতেও সহায়ক ভূমিকা রাখবে সেটি। নীতিনির্ধারণ থেকে শুরু করে বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার দিকে দৃষ্টি দিলে একটি পরিকাঠামো আগে থেকেই বিদ্যমান, যা উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে। এর বাইরে স্বতন্ত্রভাবে অনেক পরিকল্পনা অনুমোদনের জন্য কংগ্রেসে প্রেরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রো-জব ও প্রো-ইনভেস্টমেন্ট বিল। রাজনৈতিক মেরুকরণের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে এগুলো। বিশেষ করে ২০১০ সালের নির্বাচনের পর থেকে এমন নানা বিষয় বেশ গুরুত্ব পেতে শুরু করেছিল।
তৃতীয়ত. মুদ্রানীতিতে এক ধরনের নির্ভরতা কমতে দেখা গেছে, যা পরিস্থিতি বিচারে তেমন টেকসই হয়নি। এমন কিছু আর্থিক সংকট দেখা গেছে, যেখানে পরিস্থিতির দায় মানতে বাধ্য ফেডারেল রিজার্ভ হুট করে অন্য স্থান থেকে টান দিয়ে শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা চালিয়েছে। রক্ষণশীলদের হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে, যা শেষ পর্যন্ত নানা জটিলতার জন্ম দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে লাভ-ক্ষতির খতিয়ান মাথায় না রেখে নানা মেকি উন্নয়ন ও লভ্যাংশ পর্যন্ত দেখানো হয়েছে, যেগুলোর বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে খোদ নীতিনির্ধারকরাই সন্দিহান। শেষ পর্যন্ত অনিয়ন্ত্রিত পলিসি রেসপন্সের কারণেই পুরো পদ্ধতিটি মাঠে মারা গেছে।
চতুর্থত. কাঠামোগত দুর্বোধ্যতা পুরো বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার মতো সহজ ছিল না। তবে অভ্যন্তরীণ নানা অসঙ্গতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল তখন, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য মিলে ২০০৯ সালের দিকে যে জি২০ সম্মেলন করেছে। এখানে বিশ্ব অর্থনীতির নেতৃস্থানে কে থাকবে— তা নিয়ে নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই।
পঞ্চমত. ওবামা প্রশাসন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অতীতের সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি কোনো কোনো সময়। বিশ্বের অনেক দেশ তাদের স্বার্থ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি করলেও সেগুলোয় তাদের অবস্থান ছিল অপেক্ষাকৃত পেছনে। এদিকে এশিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের পত্তন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেয় যুক্তরাষ্ট্রকে। ১৯৯০ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্র যে ভূমিকা নিয়েছিল, অনেকটা তেমন পরিস্থিতি দেখা যায় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে।
আর তাই দপ্তর ত্যাগের সময় ওবামার অনেক আর্থিক উন্নয়ন স্বীকৃতির পাশাপাশি কিছু সিদ্ধান্ত তোপের মুখেও পড়তে পারে। বিশেষ করে সামাজিক অসঙ্গতি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক উষ্মা জেগে ওঠার দায়টা তিনি অস্বীকার করতে পারেন না। তবে আর্থিক ইতিহাস রচিত হলে সেখানে ওবামার অবস্থান থাকবে ইতিবাচক। আর তার সময়ের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে এ থেকে সিদ্ধান্ত নিলে ভবিষ্যতের সরকার আরো ভালো করবে নিঃসন্দেহে।
অ্যালিয়াঞ্জের চিফ ইকোনমিক অ্যাডভাইজার মুহাম্মদ আল এরিয়ানের লেখা ব্লুমবার্গ থেকে ভাষান্তরিত।