রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও অর্থনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ হলে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যায়— এমনটাই মার্কিন দর্শন। তবে এ নিয়ন্ত্রণের প্যারামিটার কতটা, তা নিয়ে আন্তেনিও গ্রামশি, জ্যাক দেরিদা কিংবা হাল আমলে নোম চমস্কির প্রশ্ন দেদার। সম্প্রতি অস্কারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যমতে, এবারের একাডেমি অ্যাওয়ার্ডে এক অর্থে দ্য রেভেন্যান্টের জয় জয়কার। বিশেষ করে অ্যাক্টর ইন আ লিডিং রোল, সিনেমাটোগ্রাফি, ডিরেক্টিং, অ্যাক্টর ইন আ সাপোর্টিং রোল, কস্টিউম ডিজাইন, সাউন্ড এডিটিং, ফিল্ম এডিটিং, সাউন্ড মিক্সিং, প্রডাকশন ডিজাইন, মেকআপ অ্যান্ড হেয়ার স্টাইলিং এবং ভিজুয়াল এফেক্টে দ্য রেভেন্যান্টের ধারেকাছে কোনোটি নেই। কিংবদন্তি অভিনেতা লিওনার্দো ডি’ক্যাপ্রিওকে পুরস্কৃত করার মধ্য দিয়ে বলতে গেলে এবার প্রকৃত অর্থে সম্মানিত হয়েছে খোদ অস্কারই। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, এবার অস্কারের জন্য নির্বাচিত কাহিনী দ্য রেভেন্যান্ট আগেই বেস্ট সেলার বই হিসেবে সম্মানিত হয়েছিল, তাই একাডেমি অ্যাওয়ার্ডে অন্য ছবির চেয়ে এগিয়ে ছিল এটি। অন্তত শুরু থেকেই রেভেন্যান্টের এগিয়ে থাকার গল্পটা অনেকের কাছে অনুমিতই ছিল।
বাংলাদেশে অমর একুশে গ্রন্থমেলার শেষ মুহূর্তে ২৯ ফেব্রুয়ারি এবার পর্দা উঠেছে অস্কারের। তাই অস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের কাহিনীকার সম্পর্কে আগ্রহটা বাংলাদেশের লেখক-পাঠক তথা বইপোকাদের একটু বেশি থাকাটা স্বাভাবিক।
দ্য রেভেন্যান্টের কাহিনী লিখেছিলেন মাইকেল পাঙ্ক, যিনি পুরোদস্তুর সরকারি কর্মকর্তা। তিনি ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনে মার্কিন অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। বিশ্বের নানা দেশের বাণিজ্যনীতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মাইকেল পাঙ্ক প্রথম রেভেন্যান্টের কাহিনী লেখার মূল রসদ পেয়ে যান। ২০০২ সালের দিকে প্রথমবারের মতো তিনি একটি উপন্যাস হিসেবে লিখেছিলেন রেভেন্যান্টের কাহিনী। এখানে তিনি তুলে আনেন উনিশ শতকের একাংশে এসে মার্কিন পশম ব্যবসায়ীদের ইতিকথা, যারা বুনো পরিবেশে জীবন ধারণের লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকে। পরবর্তীকালে আলেহান্দ্রা ইনরিতু বিশেষ কাহিনী দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এটিকে চলচ্চিত্রায়ণের চেষ্টা করে চিন্তাতীত সাফল্যের দেখা পান। তবে বলে রাখা ভালো, কাহিনীকার নয়; একজন ঔপন্যাসিক হিসেবেও পাঙ্কের সফলতা চোখে পড়ার মতো। যেবার রেভেন্যান্ট উপন্যাস হিসেবে প্রথম প্রকাশ পায়, তখনকার বাজারে সেটি বেস্ট সেলার বইয়ের মর্যাদা পায়। এ বছর একাডেমি অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার অনেক আগে থেকেই সরকারি কর্মকর্তা তকমাটা গা থেকে ছেঁটে একজন পুরোদস্তুর লেখকের মর্যাদা পেতে পারতেন পাঙ্ক। তবে মার্কিন সরকারি কর্মকর্তাদের নানা ধরনের কড়াকড়ির মধ্যে থাকার নিয়ম থেকে বিচ্যুত হতে পারেননি তিনি।
শুরু থেকে একটি প্রেক্ষাপট রচনা করে মার্কিন বাজারে বিভিন্ন লেখকের আগমন ঘটে। তবে রেভেন্যান্টের লেখক পাঙ্কের বিস্ময়কর উত্থান পর্বে কোনো ধরনের প্রেক্ষাপট তথা পটভূমি ছিল— এমনটা বলা যাবে না। বলতে গেলে বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাকে কালি-কলমের কেরামতিতে সাদা কাগজে তুলে আনাটাই তার কাজ ছিল। এর পর লেখক হিসেবে পরিচিতি কিংবা বাকি বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে লেখক পাঙ্কের তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে হয়নি বললেই চলে। অন্তত নানা মার্কিন প্রদেশে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে তিনি পশম ব্যবসায়ীদের যে ধরনের সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছেন, ঠিক তা-ই উপন্যাসের কাহিনীতে ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা ছিল তার মধ্যে। এজন্য নতুন করে তেমন কিছু যুক্ত করার তাগিদ অনুভব করেননি পাঙ্ক। শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে, মানুষ কাহিনী হিসেবে ঠিক এটাই চাইছিল। অন্তত রেভেন্যান্টের প্রতি মার্কিন জনগণের অনুরক্তির বিষয়টি সহজেই বোঝা সম্ভব বইটি বের হওয়ার মাত্র কয়েক দিনের মাথায় এটি নিঃশেষ হয়ে যাওয়া দেখে। প্রসঙ্গত, মার্কিন মুলুকে বই বিক্রি শুধু লেখকের নামে হয় না; সেখানে কোনো বই কেনার আগে জনতা তার রিভিউ ও কাহিনী দেখে যাচাই করে এটি কেনা যাবে কিনা। নানা দিক থেকে পাঠক চাহিদা পূরণে সক্ষম হওয়ায় রেভেন্যান্টের লেখককে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। উল্লেখ্য, যে বছর দ্য রেভেন্যান্টের শুটিং শুরু হয়, সে বছরও পাঙ্কের বইটি বিক্রি হয়েছিল ১৫ হাজারের উপরে। বইটি প্রকাশ হওয়ার প্রায় ১৪ বছর পরের ঘটনা এটি। অন্যদিকে বইটি প্রকাশ হওয়ার পর কতবার আউট অব প্রিন্ট হয়েছে, তা খোদ লেখকেরও হয়তো মনে নেই।
রেভেন্যান্টের লেখক হিসেবে পাঙ্কের সাফল্য এ প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। এক্ষেত্রে মার্কিন বাজারে বই বাণিজ্য থেকে শুরু করে তাদের রাষ্ট্রীয় নীতিমালার কড়াকড়ির ওপর এখানে গুরুত্ব দিতে চাইছি। লিওনার্দো ডি’ক্যাপ্রিও চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ শুরুর আগে পিকাডোর বইটির একটি অভিজাত হার্ডকভার প্রিন্ট করে ২০১৫ সালের দিকে। তবে তাদের হিসাবে এর আগেই বইটির ২১টি সংস্করণ শেষ হয়ে গেছে এবং ২১ সংস্করণে বইটির বিক্রিবাট্টা ছাড়িয়েছে অর্ধমিলিয়ন। বইটির এ বিক্রিবাট্টা ও সীমাহীন জনপ্রিয়তা লেখক হিসেবে মাইকেল পাঙ্কের জীবনকে প্রভাবিত করেছে, এটি বলার সুযোগ নেই। বিশেষ করে তিনি ছিলেন আপাদমস্তক সরকারি কর্মকর্তা, যার জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না থেকে শুরু করে উত্সব আয়োজন সবই একটি ফ্রেমে বাঁধা। এখানে তিনি চাইলেও হাজারো আনন্দের উপলক্ষে উদ্বেল হয়ে গা ভাসাতে যেমন পারেন না, তেমনি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বড়জোর বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হতে পারেন। তাই শেষ অবধি দেখা গেছে, দিনানুদৈনিক সাফল্যের আবর্তে রেভেন্যান্টের লেখক পাঙ্ক ঠাঁই নিয়েছেন জনমনে। তবে লেখকের সাক্ষাত্ পেতে সবার অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে, দেখা মেলেনি তার।
হয়তো আর ১০ জন লেখকের মতো পাঙ্ক নিজেও চাইতেন রেভেন্যান্ট নিয়ে কোনো একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে লেখক প্রতিক্রিয়া জানাতে। কিংবা কোনো বইমেলা অথবা বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সুন্দর হস্তাক্ষরে দু-একটি কথা লিখে তার নিচে অটোগ্রাফ দিয়ে ভক্তের আশা পূরণ করার ইচ্ছেটা তার ছিল না— এমনটা বলার অবকাশ নেই। তবে কঠিন নিয়মের মধ্যে থাকতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত এর সবই থেকে গেছে অপূর্ণ। তিনি শৈশবে চেয়েছিলেন একজন লেখক হবেন। তবে পারিবারিক প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে এক পর্যায়ে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন সরকারি চাকরি। তাই নিজের অজান্তে লেখক হয়ে উঠলেও কখনো স্পট লাইটে নিয়ে আসার সুযোগ মেলেনি তার। বিশেষ করে সরকারি পদে থাকার জন্য তার পক্ষে কোনো সাক্ষাত্কারে অংশ নেয়ার সুযোগ পর্যন্ত হয়নি। ফেডারেল ইথিকসের মারপ্যাঁচে সবসময় তাকে থেকে যেতে হয়েছে পর্দার অন্তরালে। এক্ষেত্রে শুধু পদাধিকারের কারণে পত্রিকায় প্রকাশিত কোনো রিভিউতে পর্যন্ত তিনি মন্তব্য করতে পারেননি। এটি নিয়ে পাঙ্কের কোনো ক্ষোভ কিংবা বিবৃতি না থাকলেও শেষ অবধি খোদ পিকাডোরের প্রকাশক স্টিফেন মরিসনের জবানিতে আক্ষেপের সুর স্পষ্ট। তিনি বলেন, একজন লেখক হিসেবে এমন বিধি-নিষেধের মধ্যে থেকে কাজ করাটা নিঃসন্দেহে হতাশাজনক।
একজন লেখক তার বই বিক্রির জন্য নানা ধরনের প্রচারণামূলক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারলেও শুরু থেকে মাইকেল পাঙ্ক ছিলেন এর ব্যতিক্রম। এমনকি তার সাড়া জাগানো উপন্যাস রেভেন্যান্ট নিয়ে যখন চলচ্চিত্রায়ণের কাজ শুরু হয়েছে, তখন তিনি এর প্রিমিয়ারেও উপস্থিত হতে পারেননি। তিনি তখন রাষ্ট্রীয় কাজে নাইরোবিতে অবস্থান করছেন। সেখানে অর্ধপরিবাহী, জিপিএস ও অন্য প্রযুক্তিগত উপকরণের পাশাপাশি মেডিকেল ডিভাইসের একটি ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের চুক্তি করার জন্য উপস্থিত ছিলেন। তার পক্ষ থেকে ভাই টিম পাঙ্ক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে তাকে জানিয়ে দিয়েছেন ভাইয়ের অক্ষমতার কথা। তবে তিনিও আক্ষেপের সুরে বলেছেন, এটি যেকোনো লেখকের জন্য স্বপ্ন যে, তার লেখা যখন চলচ্চিত্রায়ণ হবে কিংবা এর পর্দা উঠবে, সেখানে তিনি উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু মাইকেল পাঙ্ক এটি পারেননি, যা সত্যিই যেকোনো লেখকের জন্য অনেক কষ্ট ও হতাশার।
পাঙ্কের সাফল্যে তিনি নিশ্চুপ থাকলেও তার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে ঠিকই বিবৃতি এসেছে। সেখানে সরাসরি জানিয়ে দেয়া হয়েছে, সবাই তার জন্য কতটা গর্বিত। তিনি নিভৃতে কাজ করতে গিয়ে অনেক শিক্ষা রেখে গেছেন বিশ্বের জন্য। বিশ্বের অনেক দেশে মার্কিন নীতি কমবেশি সমালোচিত ও বিতর্কিত তার কর্মভূমিকার জন্য। তবে রাষ্ট্রীয় নীতির এ কঠোরতাই তাদের সাফল্যের মূলমন্ত্র হয়ে উঠেছে। পাঙ্কের নিভৃতে কাজ করে যাওয়ার এক পর্যায়ে স্বাভাবিক সাফল্য অনেকের জন্য অনুপ্রেরণার উপলক্ষ হতে পারে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে যেসব পরিচালক চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য কাহিনী নির্বাচনে হিমশিম খান, এখানে শিক্ষার বিষয় রয়েছে তাদের জন্যও। অন্তত এ থেকে সহজে প্রতীয়মান হয় যে, কাহিনী নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন কাহিনী নেয়া উচিত, যা গণমানুষের জীবনঘনিষ্ঠ এবং তা সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। একজন লেখক তার গল্প, উপন্যাসের কাহিনীতে এটি ফুটিয়ে তুলতে পারলে সাফল্য আসবে।