আবাবিল পাখি নাকি কাবাঘর তাওয়াফ করছে মানুষের অনুপস্থিতে। সত্যিই মাথা গরম করে দেয়ার মতো বিষয়। বিশ্বের অবাক কিছু ঘটনা আর কন্সপিরেসি থিওরি অনেকটা একই সুতোয় গাঁথা। গুপ্তগোষ্ঠী ইলুমিনাতিসহ গুপ্তগোষ্ঠী সিরিজ এর বাকি বইগুলোতে আমি এগুলোর তুলনামূলক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছি। পৃথিবীর সব পর্যটন কেন্দ্রের মতো ইসলামের পীঠস্থান কাবাতেও এখন জনসমাগম নাই। মুক্ত কাবার চারপাশে চক্কর দিতে দেখা যাচ্ছে আবাবিল পাখিদের। অনেকে এই ঘটনার ভিডিওকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করে বেড়াচ্ছে ‘আবাবিল কাবা তাওয়াফ করছে’ বলে।
এই ভিডিও প্রচার করার আগে একবার ভাবা উচিত কাবা তাওয়াফ কেবল মুসলমানদের জন্য আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ । পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরানের ৯৬ ও ৯৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানব জাতির উদ্দেশ্যে বলেছেন-
إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِلْعَالَمِينَ (96) فِيهِ آَيَاتٌ بَيِّنَاتٌ مَقَامُ إِبْرَاهِيمَ وَمَنْ دَخَلَهُ كَانَ آَمِنًا وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ (97)
“মক্কাতেই মানবজাতির জন্য সর্ব প্রথম ঘর তৈরি হয়েছিল। ঐ ঘর বিশ্ববাসীদের জন্য হেদায়াত ও বরকতের উৎস।” (৩:৯৬)
“আর তাতে অনেক স্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে। যেমন মাকামে ইব্রাহীম বা ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর স্থান এবং যারাই এ ঘরের মধ্যে আশ্রয় নেয় তারাই নিরাপদ। আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ ঘরের হজ্ব সমাপন করা তাদের অবশ্যই কর্তব্য। যারা সেখানে যাবার সামর্থ রাখে এবং যদি কেউ অবিশ্বাস করে অর্থাৎ সামর্থ থাকা সত্ত্বেও হজ্ব না করে তাহলে সে জেনে রাখুক আল্লাহ বিশ্বজগতের কোন কিছুরই মুখাপেক্ষী নন।” (৩:৯৭)
বিভিন্ন তাফসীর থেকে দেখা যায়, ইসলামের অনুসারীদের বিরুদ্ধে ভিন্নধর্মী তথা সিংহভাগ ক্ষেত্রে ইহুদিবাদীদের অন্যতম অভিযোগ ছিল- হযরত ইসা (আ) এর জন্মের প্রায় এক হাজার বছর আগে হযরত সোলায়মান (আ.) বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ নির্মাণ করার পরও মুসলমানরা কেন কাবা ঘরকে তাদের কেবলা হিসেবে স্থির করেছে? তাদের মতে,কাবা ঘরের বয়স খুব বেশী নয়। পবিত্র কোরআন এর জবাবে বলছে, কাবাঘরই হচ্ছে প্রথম ঘর যা মানুষের ইবাদতের জন্যে নির্মিত হয়েছে এবং যে কোন মসজিদ বা উপাসনালয়ের চেয়ে কাবা ঘর বেশি প্রাচীন। সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণাতেও এর উপযুক্ত প্রমাণ মিলেছে।
ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম মানব হযরত আদম (আ.)-ই কাবা ঘরের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং প্রায় প্রতিটি নবী ও রাসূল এই কাবাগৃহ তথা মাসজিদুল হারাম যিয়ারত করেছেন। প্রত্নস্থান গঠন প্রক্রিয়া তথা Site Formation Process এর নানা পর্যায়ে কাবা গৃহের মূল ভিত্তির অংশবিশেষ ভূমি অন্তরীণ হলে পরবর্তীকালে হযরত ইবরাহীম (আ.) কাবা ঘর পুনর্নিমাণ করেন। তখন থেকেই মূল কাবাগৃহের যিয়ারতের বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচলিত হয় যেখানে হযরত ইবরাহীম আ: কে বলা বয় মুসলিম জাতির পিতা।
স্পষ্ট দলিলে পবিত্র কুরআনের সূরা হাজ্জের ৭৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
) وَجَاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِ هُوَ اجْتَبَاكُمْ وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ مِلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ مِنْ قَبْلُ وَفِي هَذَا لِيَكُونَ الرَّسُولُ شَهِيدًا عَلَيْكُمْ وَتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآَتُوا الزَّكَاةَ وَاعْتَصِمُوا بِاللَّهِ هُوَ مَوْلَاكُمْ فَنِعْمَ الْمَوْلَى وَنِعْمَ النَّصِيرُ (78)
“তোমরা আল্লাহর জন্য জিহাদ করো যেভাবে জিহাদ করা উচিত। তিনি তোমাদের মনোনীত করেছেন। তিনি তোমাদের ধর্মে তোমাদের জন্য কঠিন কোনো বিধান দেননি। এই দ্বীন তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের দ্বীনের অনুরূপ। আল্লাহ এর আগে তোমাদের নামকরণ করেছেন- ‘মুসলিম’ এবং এই কিতাবেও তা করেছেন; যাতে রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষী হয় এবং তোমরাও সাক্ষী হও মানব জাতির জন্য। সুতরাং তোমরা নামাজ কায়েম করো, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে শক্তভাবে ধারণ করো। তিনিই তোমাদের অভিভাবক, কতো উত্তম অভিভাবক এবং কতো উত্তম সাহায্যকারী তিনি!” (২২:৭৮)
যাই হোক এই আয়াতের মাধ্যমে ইবরাহীম আ: কে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে। তারপর পরিপূর্ণতা এসেছে রাসূল সা: কে রাহমাতুল্লিল আলামিন ঘোষণার মধ্য দিয়ে। যেখানে একইরকম স্পষ্ট দলিলে ঐ একই সূরা অর্থাৎ সূরা হজ্জের ১০৭ নং আয়াত বলছে —
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ
আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।
যাই হোক কাবাঘর বিশ্ব মুসলিম ঐক্যের অন্যতম নিদর্শন। মুসলমানরা কাবাঘরের দিকে মুখ ফিরিয়ে প্রতিদিন ৫ বার নামাজ পড়া ছাড়াও প্রতি বছর কাবাঘরে সমবেত হয়। যেসব মুসলমানের আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ রয়েছে, তারা জীবনে অন্তত একবার মুসলমানদের এই বার্ষিক হজ্ব সম্মেলনে অংশ নেয়। কাবাঘরের দেয়াল উঁচু করার সময় হযরত ইবরাহীম (আ.) একটা বড় পাথরের ওপর দাঁড়াতেন। তাই ইব্রাহীম (আ.)’র স্মৃতিবাহী এই পাথরকেও মানুষ পরম শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং এটিই ‘মাকামে ইব্রাহীম’ নামে পরিচিত।
হযরত মুসা (আ.)’র জন্মের কয়েকশ’ বছর আগে কাবাঘর পুনর্নিমিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী কয়েকশ’ বছরের বন্যা ও বিভিন্ন পরিবর্তনের পরও ঐ পাথরটি অক্ষত থেকে আল্লাহর নিদর্শনে পরিণত হয়েছে। কাবাঘর যিয়ারতকারীদের জন্য এটা একটা শিক্ষণীয় দিক। অন্যদিকে মক্কা ও কাবাঘর আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষিত নিরাপদ স্থান। এখানে জীবন্ত কোন কিছুর প্রাণহরণ নিষিদ্ধ, তা লতা-পাতা, পাখী, মশা ও মাছি যাই হোক না কেন। এমনকি কোন অপরাধীও যদি কাবাঘরে প্রবেশ করে তাহলেও এর প্রতিবাদ করা যাবে না। তবে তার জন্য এমন ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে, যাতে সে নিজেই কাবাঘর থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
এতকথা বললাম একটা কারণে যে মক্কায় তাওয়াফ এবং ইবাদত পুরোটাই মানুষ তথা মুসলিম ধর্মবিশ্বাস কেন্দ্রিক। পাঞ্জেগানা সূরার বই থেকে বাংলা কিংবা স্বদেশী ভাষায় যারা সূরা ফিল মুখস্থ করেন, তারপর হুজুরদের, ওয়াজ শোনেন যে আবাবিল পাখি কাবা রক্ষা করে তাদের জন্য এখনকার পাখির তাওয়াফও এক রকম বিভ্রান্তি। মনে রাখতে হবে আল্লাহর নির্দেশে আবাবিল এসেছিল কাবা রক্ষা করতে। এখন করোনা ভাইরাসের প্রভাবে মানুষ কাবা তাওয়াফ বন্ধ রাখছে। এখানে কাবা কেউ ভাঙ্গতে কিংবা ক্ষতি করতে আসছে না বলে খামোকা আবাবিল নিয়ে চিৎকারের প্রয়োজন নাই।
মুক্ত পরিবেশ পেয়ে খোলা আকাশে ওড়া পাখির স্বভাব, সেটা কাবা হোক, অন্যকোনো মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা, সিনাগগ কিংবা গুরুদুয়ারা যাই হোক। এটাকে অতিপ্রাকৃত ঘটনা হিসেবে মনে করে অনেতুক মাথা গরম করার কিছু নাই। ইরান ও পাকিস্তানের কিছু টিভি চ্যানেল একটা অহেতুক রং লাগিয়ে উপস্থাপনা করছে। কবে শুনবেন বাংলাদেশের কোন ওয়াজী হুজুর এটাতে আরও রঙ লাগিয়ে ঢঙ করে বক্তৃতা শুরু করে দিতে পারে। আমরা আগে থেকে সতর্ক থাকি। এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করি সূরা আল আম্বিয়ার ৮৭ নং আয়াত থেকে…
لَّا إِلَٰهَ إِلَّا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
বিপদ-আপদ ও গযবের দিনে ফিৎনা ছড়ায় বেশি। আমরা সবাই কমবেশি নিজে জেনে বুঝে তারপর তা আমলের চেষ্টা করি। যার তার কথা শুনে মাথা গরম না করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে মাফ করুন।পুরো বিশ্বের মানুষ দ্রুত করোনা নামের আপদ থেকে মুক্তি পাক। আমীন।