মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও নবজাগরণের অগ্রদূত মাহাথিরের গল্পটা হয়তো আমাদের অজানা নয়। তিনি নিজ দেশের সবকিছু অন্যদের চেয়ে উন্নত দেখতে চেয়েছিলেন। একবার বুকে ব্যথা অনুভূত হলে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। তবে সেখানে উন্নত চিকিত্সাসেবার সুযোগ ছিল না। তাকে ডাক্তাররা উন্নত চিকিত্সার জন্য অন্য দেশে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি তা সরাসরি ফিরিয়ে দেন। পরে কয়েক দিন অপেক্ষা করে ওই দেশ থেকে যন্ত্রাংশ নিয়ে উপযুক্ত সুবিধা মালয়েশিয়ায় নিশ্চিত করে চিকিত্সা নিয়েছিলেন তিনি। গল্পটা বেশ জনপ্রিয় হয়েছে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কল্যাণে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসে একই রকম গুরুত্বপূর্ণ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর গল্পটা এখনো অজানা রয়ে গেছে। বিশিষ্ট লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর ‘মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী’ শীর্ষক গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-২৯৫) উল্লেখ করেছেন অজানা বিষয়টি। রোগশয্যায় মজলুম এ জননেতা কীভাবে তাঁর দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন, সেটা জানার সুযোগ হয়েছে এ বই থেকে।
১৯৬৭ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত দীর্ঘ আড়াই মাস তিনি ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ সময় তিনি মূত্রাশয়ের চিকিত্সা নিচ্ছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় অন্য কোনো সময় এত দিন হাসপাতালে কাটিয়েছেন বলে জানা যায় না। ডা. জেমস ক্যামেরুন, ডা. আসির উদ্দিন, ডা. নূরুল ইসলামসহ আরো অনেককে নিয়ে তাঁর চিকিত্সায় গঠন করা হয়েছিল একটি মেডিকেল বোর্ড। চীন ও সোভিয়েত সরকার পর্যন্ত তাঁকে সেখানে নিয়ে বিনা খরচে চিকিত্সাসেবা দেয়ার প্রস্তাব দেয়। এদিকে প্রবাসী বাঙালিরাও প্রাণপণে চেয়েছিলেন মওলানা চিকিত্সা নিতে যেন দেশের বাইরে যান। সেখানকার উন্নত চিকিত্সা নিয়ে অন্য সবাই যতটা আগ্রহী ছিলেন, তার বিপরীতে মওলানা দেশেই থেকে যাওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। এর প্রমাণ মেলে ডা. নূরুল ইসলামের বর্ণনা থেকে।
অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলাম ঘটনাটির স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, “প্রফেসর ক্যামেরুনের সঙ্গে আমিও তাঁকে দেখলাম। প্রস্টেটের অপারেশন হবে। চীন, রাশিয়া দু’দেশই তাঁকে চায়। বিনা খরচায় সেখানে তাঁর চিকিত্সার ব্যবস্থা হবে। মওলানা সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, ‘আমার দেশের ডাক্তাররা কোনো অংশে কম নয়। আসিরউদ্দিন একজন নামকরা সার্জন, সে-ই করুক।’ অবশেষে তাই হলো। অপারেশনের পর মওলানা সাহেব ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। আমাকে প্রায় বলতেন, “বিদেশে যতো কিছু করুক, ও-সব অর্টিফিশিয়েল। আন্তরিকতা আমাদের ডাক্তারদেরই আছে। নার্সদের যে সেবা পেয়েছি, আমার শত কাজের মাঝেও আমি তা ভুলতে পারি না।”
মওলানা ভাসানীর চিকিত্সা নেয়ার এ ঘটনা আজ থেকে প্রায় ছয় দশক আগের। তিনি দেশ ও দেশের চিকিত্সকদের প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। ফলে ডাক্তার ও নার্সরা তাঁর সেই আস্থার প্রতিদান দিতে চেষ্টা করেছিলেন। ফলে তখনকার চিকিত্সাসেবা নিয়ে অতটা অসন্তোষ ছিল না, ঠিক যতটা এখন তৈরি হয়েছে। পুঁজিপতি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা— গুরুতর রোগ তো বটেই, সামান্য কোনো কিছু হলেই দেশের অর্থ অপচয় করে এখন পাড়ি দিচ্ছেন বাইরে। বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতারা তাদের রুটিন চেকআপ পর্যন্ত করাচ্ছেন থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়ায়। আর নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চ মধ্যবিত্ত সবার লক্ষ একটাই, কলকাতা কিংবা চেন্নাই। এ আস্থার সংকট ধীরে ধীরে ভঙ্গুর করে তুলেছে আমাদের চিকিত্সা খাতকে। চিকিত্সার যথাযথ সুযোগ নেই মনে করে মানুষ দেশের হাসপাতালগুলো থেকে সরে যাচ্ছে। এতে দক্ষতা হারিয়ে চিকিত্সকরা হয়ে পড়ছেন অপেক্ষাকৃত অদক্ষ; হাসপাতালগুলোও অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে প্রয়োজনীয় সেবাদানের। নতুন করে দেশের চিকিত্সাসেবাকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে সবার আগে আস্থাটা ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্তত মওলানা ভাসানীর এ আদর্শ সামনে রেখে রাজনৈতিক নেতারা যদি দেশের হাসপাতালগুলোয় চিকিত্সা নিতে শুরু করেন, তবে ধীরে ধীরে সংকট কাটবে। প্রয়োজনের তাগিদেই উন্নত হবে দেশের চিকিত্সা ও সেবা খাত।