গ্রিসের ঋণ সংকট নিয়ে নির্মম বাস্তবতা হলো, এর নজিরবিহীন বিক্ষেপ। ইউরোজোনের প্রায় ২ শতাংশ জনগোষ্ঠীর অর্থনীতির সঙ্গে এ অঞ্চল সম্পর্কিত। তবে তার মানে এই নয় যে, গ্রিসকে গুরুত্বহীন করে তুলতে হবে। বিশেষ করে ইউরোজোনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এ দেশ কিছু ক্ষেত্রে আলোচনার দাবি রাখে। এক্ষেত্রে ধরে নেয়া যেতেই পারে, গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট দ্রুত নিরসন সম্ভব এবং পরিস্থিতি আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠতেও সময় নেবে না।
কারেন্সি সমস্যার মতো বিভিন্ন আনুষঙ্গিকতা এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে নানামুখী জটিলতার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে কমন কারেন্সির কথা বলা যেতে পারে। ইউরোপের নানা দেশের পাশাপাশি গ্রিসেও ইউরোর গুরুত্ব বেড়েছে বহুগুণে। অনেকে প্রশ্ন করছেন, দেশটির অর্থনীতির স্বাতন্ত্র্য কি হারিয়ে যাবে? আর তাদের অর্থনীতি যদি কার্যত বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যায়, পরবর্তী অবস্থানে কে আসবে? পর্তুগাল, স্পেন নাকি ইতালি— কে জানে?
এ সন্দেহ ধীরে ধীরে ঘনীভূত হওয়ার একটি পর্যায়ে এসে অর্থনৈতিক পরিসরে যে ধস লক্ষ করা গেছে, তা থেকে উত্তরণ অতটা সহজ হয়নি। উপরন্তু সেখানে ব্যর্থতার চিত্র অনেকটাই স্পষ্ট। গ্রিসের ব্যাংক থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করে নেয়ার মধ্য দিয়েই সংকটের শুরু। মানুষ তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি বলেই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই লগ্নিকৃত অর্থ ফিরিয়ে নিতে চেয়েছে। ব্যাংকগুলোয় সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট তাদের আরো সমস্যার সম্মুখীন করেছে। মারিও দ্রাঘির নিয়ন্ত্রণাধীন ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক আর্থিক খাতে বড় রকমের ধসের আশঙ্কা করছে। দ্রাঘি মনে করেন, গ্রিসের ব্যাংকগুলোয় সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট এত সহজে দূর হবে না। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে এত বড় পতনকে সহজে মেনে নিতে পারছেন না বেশির ভাগ বিশ্লেষক।
সম্প্রতি গ্রিসে ঋণ-সম্পর্কিত যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, তার হিসাব করলে আঁতকে উঠতে হয়। বিশেষ করে বাইরে থেকে নেয়া ঋণ তারা অভ্যন্তরীণভাবে কিছুতেই শোধ করতে পারবে না। এরই মধ্যে বৈদেশিক ঋণের পরিমান দেশটির জিডিপির ১৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। তবে বাম দলগুলো সংস্কার কর্মসূচির নানা অসঙ্গতি খুঁজে বের করে তার বিরোধিতা করেছে। তাদের প্রতিবাদ অনেকটাই বার্লিন কিংবা ব্রাসেলসের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে সবাইকে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী করতে হয়, ভার্সাই চুক্তির সমকালে, আজ থেকে ৯৬ বছর আগেই শিখিয়ে গেছেন জন মেইনার্ড কেইনস। তিনি এখানে কর্তব্য নাকি মানবতা— দুটি বিশেষ পরিসর থেকে প্রশ্ন করে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলেছেন। আর সিদ্ধান্তটি স্বভাবতই হয়ে ওঠে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও মানবিক। বিশেষ করে বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের পরিস্থিতি কিংবা স্নায়ুযুদ্ধের বাস্তবতায় এর বাইরে যাওয়াটা অনেক কঠিন হয়ে দেখা দেয়।
অনেক জার্মান এখনো মনে করেন, ঋণ আর কিছু না ঋণই; যা অবশ্য পরিশোধযোগ্য। গ্রিসের কাছে যা পাওনা হয়েছে, সেটা তাদের পরিশোধ করতেই হবে। আর তাদের বিশ্বাস, গ্রিস ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবে। জার্মানির অর্থনীতি নিয়ে কেইনসের বিবৃতি অনেক দিক থেকে ব্যর্থ হয়েও দেখা দিয়েছে। মার্শাল প্ল্যানের আওতায় জার্মানি যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেক্ষেত্রেও অনেকটা নতুনত্ব ছিল। এর সঙ্গে জার্মানির ঋণ নিয়ে ১৯৫৩ সালে সম্পন্ন লন্ডন চুক্তির কথা উল্লেখ করা যায়। ওই সময়ের চুক্তি জার্মানিকে স্বস্তির সন্ধান দিতে পেরেছিল, যা অনেক দিক থেকেই কাঙ্ক্ষিত ছিল। বিশেষ করে সামরিক থেকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকতে থাকা জার্মানির জন্য একটি পরিবর্তিত চিন্তাধারা আবশ্যক ছিল। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য উপযুক্ত অর্থনৈতিক উন্নয়ন জরুরি ছিল। আর ঋণ গ্রহণ পরিস্থিতিসাপেক্ষে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তখন অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে জার্মানি যে উদ্যোগ নিয়েছিল, গ্রিস এখন ঠিক সে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। জার্মানি, ফ্রান্স কিংবা পশ্চিমা বিজনেস টাইকুনরা গ্রিসের অর্থনীতিতে যে ভূমিকা রাখছে, সেটাও বিবেচনায় রাখা উচিত। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে, ১৯৫৩ সালের দিকে যে পদ্ধতি অনুসরণ করে জার্মানি সংকট থেকে নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল, এখন গ্রিসও সেটা কাজে লাগাতে পারে।
তাত্ত্বিক দিক থেকে চিন্তা করলে গ্রিসের সাম্প্রতিক সংকট থেকে উত্তরণ অতটা জটিল কাজ নয়। বিশেষ করে বাইরের দেশ থেকে গ্রিস যে ঋণ নিয়েছে, সেটা অনেক দীর্ঘমেয়াদি এবং স্বল্প সুদের। শূন্য দশমিক ৫ থেকে শুরু করে ১ শতাংশ সুদে প্রায় ২০২০ সাল পর্যন্ত পরিশোধের সুযোগ রয়েছে এটি। আর ব্যতিব্যস্ত না হয়ে পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণই এখন কাম্য। নানা সংকট থেকে উত্তরণে এটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তবে ঋণ সমস্যা থেকে উত্তরণ গ্রিসের সব ধরনের অর্থনৈতিক সংকট দূর হয়ে যাবে, এমনটা নয়। সমস্যা সমাধানের জন্য ভিন্ন চিন্তা করাটা জরুরি। নতুন ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত থেকে শুরু করে রফতানি বাজারের দিকে দৃষ্টি দেয়াটাও জরুরি। বিশেষ করে একুশ শতকের বাস্তবতায় গ্রিস ভূমধ্যসাগরীয় প্রকৃতির সুবিধা নিয়ে যে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার শুরু করেছে, তা আরো জোরদার করতে হবে বাণিজ্য আমলে নিলে সংকট উত্তরণে আরো যত্নবান হওয়া উচিত তাদের।
লেখক: মার্কিন অর্থনীতিবিদ জেফরি স্যাকসের লেখা দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তরিত।