দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ নেপাল। পাহাড়-ঝর্নার পাশাপাশি সীমিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অনন্য সাধারণ ব্যবস্থাপনা গত এক যুগ ধরে পর্যটন শিল্পে তাদের উন্নতিকে নিয়ে গেছে ঈর্ষণীয় অবস্থানে। পোখারা উপত্যকার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি সেখানকার পর্যটন বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে উত্সবের নগরীখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ ভক্তপুর। ভক্তদের নগরী হলেও বছরের বেশিরভাগ সময় তা মুখরিত থাকে বিশ্বের নানা দেশ থেকে আগত পর্যটকদের পদচারণায়। দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর পাশাপাশি টেলিভিশন ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সম্প্রতি নেপালে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কারো অজানা নয়। বিশিষ্ট গবেষক কেনেথ চ্যাং নিউইয়র্ক টাইমসে লিখেছেন প্রতি ৭৫ বছর অন্তর অন্তর ভূতাত্ত্বিক কারণেই এ অঞ্চলে এমন ভূমিকম্প হতে পারে। তবে পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায় এবারের দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আশংকাকেও অতিক্রম করে গেছে। অগণিত মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নেপালের অমূল্য ঐতিহ্যিক নিদর্শন।
বার্তা সংস্থা এএফপির সূত্র দিয়ে বাংলাদেশেরও অনেকগুলো দৈনিক প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য ধরহারা টাওয়ার এর ছবি ছেপেছে। তবে এবারের ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নেপালের প্রত্নঐতিহ্যকে বিশ্ব দরবারে পরিচয় করিয়ে দেয়া ভক্তপুর। সেখানে লাইয়াকুর (Layaku) বিখ্যাত দরবার স্কয়ার থেকে শুরু করে নাইয়াতাপোলার (Nyatapola) মন্দির, ভৈরব নাথ মন্দির, দত্তাতারাইয়া (Dattatraya) মন্দির, চ্যাংগুনারায়ণ, সিদ্ধাপোখারি তথা তা পুখু এবং কৈলাসনাথের মাধব মূর্তি এর কিছুই রক্ষা পায়নি এবারের ভূমিকম্পে। বছরের প্রথম থেকে নানা উত্সব পার্বণে জমজমাট থাকা এ নগরীর শেষ আয়োজন বছরান্তের হোলি পার্বণীতে। সব উত্সবের রঙ এখন হারিয়ে গেছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপের ভক্তপুর এখন মৃতদের নগরী, চারদিকে উঠেছে কান্নার রোল। যে শহর সারাটি দিন ভক্তরা থাক আর নাই থাক পর্যটকের কোলাহলে মুখরিত থাকতো, সে শহরের বিক্রি বাট্টা পুরো নেপালের জিডিপির সিংহভাগ বয়ে আনতো সেখানে আজ শুধুই হাহাকার। ভূমিকম্পের প্রলয় সব শেষ করে দিয়েছে রত্নগর্ভা এ নগরীর।
অনেকগুলো ঐতিহ্যবাহী উত্সবের নগরী এই ভক্তপুর। বিক্রম সংবত্ অনুযায়ী নববর্ষের একেবারে প্রথম দিন থেকে না হয়ে বছরান্তেই শুরু হয় বরণোত্সব। নতুন বছর শুরুর বেশ আগে থেকেই সচরাচর চৈত্রের ২৭ তারিখ থেকে ভক্তপুর জুড়ে থাকে সাজ সাজ রব। তাদের দেবী ভদ্রকালি এবং দেবতা ভৈরবের সম্মানে তৈরি করা হত অনন্যসুন্দর রথ। তারপর রথে দেব-দেবীকে চড়িয়ে নিয়ে শোভাযাত্রা বের করা হয় ভক্তপুরের রাস্তায়। উত্সবের সময়টাতে দেশি-বিদেশির মিলনমেলায় যেন লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে এই সুন্দর সাজানো-গোছানো শহরটি। নওজোয়ানরা যখন ভক্তপুরের রাস্তা দিয়ে এই রথ টেনে নিয়ে যায় তখন পড়ে যেত পুণ্যার্থীদের নানা আয়োজনের ধুম। বিভিন্ন ধরনের ফুল, চাল-ডাল, আটা, বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা থেকে শুরু করে রক্তিম সিঁদুরের নৈবেদ্যে স্বাগত জানানো হত দেব-দেবীকে। আর বছরান্তের দিনটিতে বিশালাকৃতির কাঠে তৈরি খাম্বাসদৃশ ‘যেশিংধ’ তথা লিঙ্গ তৈরি করা শহরের একপ্রান্তে।
সাপ কিংবা নাগ-নাগিনীর প্রতীকী রূপ হিসেবে লম্বা লম্বা সুসজ্জিত ব্যানার ঝুলানো হয় এই খাম্বা থেকে। তারপর নতুন বছরের শুরুতে এটিকে নামিয়ে ফেলে অশুভ শক্তির উপর জয় ঘোষণার রেওয়াজ ছিল বেশ বিখ্যাত। এভাবে বৈশাখের পঞ্চম দিনে আরেকটি শোভাযাত্রার মাধ্যমে শেষ হত ভক্তপুরের বর্ষবরণ। কিন্তু এবারে বর্ষবরণের হপ্তা না পেরুতেই এমন বসন্তবৈরির শোকাবহ পরিবেশ তৈরি হবে কে জানত। তাইতো মাতাতীর্থআনুশি, বুদ্ধ পূর্ণিমা, সিঁথিনাখা, গাথামাগাচার্য, গাইয়াত্রা, কুশিআসুই, ইন্দ্রাইয়াত্রা, নবরাত্রি, কিজাপূজা, সাকিমাপূণ্যি, যমারিপূর্ণিমা, মাঘি সংক্রান্তি, শ্রী পঞ্চমী, শিবরাত্রি, হোলি আর কর্কট সংক্রান্তির শহর ভক্তপুরে এখন সবসুর চাপা পড়েছে বিষাদের ঘনঘটায়। উত্সবের মোহনীয়তা গ্রাস করেছে কান্নার রোল। বিভিন্ন গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দেখা গেছে ধসে পড়া একটি পানির ট্যাংক আটকে আছে গাছের খাঁজে, রাস্তাগুলো বৈশাখের তপ্তরোদে ফুটিফাটা হওয়ার ক্ষেতের মত চৌচির। চারদিকে ইট-সিমেন্টের ধ্বংসস্তূপের ফাঁকে যেটুকু চোখে পড়ে বড় বড় সব ফাটল। উপর থেকে উল্টো হয়ে ঝুলতে থাকা পতাকার সাথে কারো পোশাক যাতে আবার ছোপ ছোপ রক্ত লেগে আছে। পরিত্যক্ত গ্যাসের চুলা আর সিলিন্ডার, হাড়ি-পাতিল ও অন্যসব তৈজসপত্র এমনি ধ্বংসলীলায় হারিয়ে গেছে ঐতিহ্যের ভক্তপুর।
১২-১৮ শতক পর্যন্ত নেপালের ইতিহাসে মল্ল রাজাদের আধিপত্য ছিল। ভক্তপুরের এ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো গড়ে উঠেছিল তাদের সময়েই। এখানে নির্মিত হিন্দু নিদর্শনগুলোর পাশাপাশি বেশ কিছু বৌদ্ধ সংস্কৃতির চিহ্নও চোখে পড়ে। নেপাল মণ্ডলের শাসনকর্তা হিসেবে ভক্তরা ঠিক কোন সময়ে এ স্থানের মন্দিরগুলো নির্মাণ করেছিলেন তার স্বপক্ষে নির্ভরযোগ্য প্রমাণের অভাব রয়েছে। পাশাপাশি এসব নিদর্শন একসাথে নির্মিত হয়নি। ফলে একই স্থানে তৈরি হওয়া মন্দিরগুলোর গাঠনিক বৈচিত্র্য চোখে পড়ার মত। অন্যদিকে প্রাচীন আমলে নির্মিত বিভিন্ন মন্দির বেশ কয়েকবার সংস্কারের ফলে আদি রূপ বদলে গিয়ে ভিন্নরকম অবস্থায় উপনীত হয়েছে।
নেপালের ইতিহাস আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে ভূমিকম্প পরস্পর সম্পর্কিত। বিশেষ করে ১২৫৫ সালের দিকে কাঠমান্ডুর ত্রিশ হাজার জনগোষ্ঠীর এক তৃতীয়াংশ জনগণের পাশাপাশি রাজা অভয় মল্ল পর্যন্ত মারা গিয়েছিলেন এক সর্বনাশা ভূমিকম্পের আঘাতে। সে সময়ের ভূমিকম্পেও এপিসেন্টার ছিল ঠিক শহরের নিচেই। আর এ শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত ভক্তপুর তখনও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৩৪৬ সালের পরে স্বয়ম্ভুনাথের মন্দিরে গচ্ছিত অর্থসম্পদ লুট করার উদ্দেশ্যে বাংলার স্বাধীন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ নেপাল আক্রমণ করেন। রাজা জয়রাজদেবের শাসনামলে (খ্রি. ১৩৪৭-১৩৬১) অর্ধশতক আগের দুর্যোগ কাটিয়ে অনেকটা সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় রত নেপাল তখন আরেক দফা ধাক্কা খায়। তবে শামস উদ্দিন ইলিয়াস শাহের আক্রমণে সেখানকার সংস্কৃতি তেমন প্রভাবিত হয়নি। অবশ্য অনেক ইতিহাসবিদ দাবি করেছেন সেসময়ে চান্দেল্ল্য ও বাঘেলায় সমসাময়িক কয়েকটি মন্দির এবং অনেকগুলো লিচ্ছবি রাজপ্রসাদ ধ্বংস হয়েছিল। ইলিয়াস শাহ মাত্র তিনদিনের আক্রমণ ও লুণ্ঠন শেষে নিজ রাজধানীতে ফিরে গিয়েছিলেন। এরপর জয়স্থিতি মল্লের শাসনামলে (খ্রি. ১৩৮২-১৩৯৫) সেখানকার পরিস্থিতি অনেক স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল বলে মনে করা হয়। আর বেশিরভাগ স্থাপত্য নিদর্শন তার সময়েই নির্মিত হয়ে থাকতে পারে।
পর্যটকের ভিড়ে সদা সরগরম থাকা ব্যস্ত এ শহরের ভিড় ছাপিয়ে এখন ধ্বংসের দঙ্গল। ঐতিহ্যিক নিদর্শন থেকে শুরু করে সাধারণ বাড়ি-ঘর কোনোকিছুই রক্ষা পায়নি এ ভূকম্পনের প্রকোপ থেকে। নেই বিদ্যুত্ সংযোগ কিংবা সেখানকার পানির সরবরাহ ব্যবস্থা। ভূমিকম্পের পর মাটিতে পড়ে থাকা বৈদ্যুতিক খুঁটি আর পানির ট্যাংকগুলোর ভগ্নদশাই প্রমাণ দিচ্ছে কি ভয়াবহতার সম্মুখীন এ নগরী। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্তি আর পর্যটনের ক্ষেত্রে অসাধারণ ব্যবস্থাপনা এ নগরীকে বিশ্ববাসীর কাছে করেছিল জনপ্রিয়। তাই বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের পর্যটক এশিয়ার দেশগুলো বেড়াতে এলে অন্তত একবারের জন্য হলেও নেপালের ভক্তপুর ঘুরে যেতে ভুলতেন না। ফলে সেখানকার মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও দিনকে দিন হয়ে উঠেছিল নেপালের অনেক স্থানের চেয়ে ভালো। যা আজ কেবলি স্মৃতি। নানাস্থানে শিশুদের অবিরাম কান্না আর মানুষের আহাজারি প্রবল খাদ্য সংকটের কথা জানান দিচ্ছে।
হাজারো মানুষের প্রাণহানির শোক যেখানে মুখ্য, ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রত্নঐতিহ্যের দিকে দৃষ্টি দেয়ার সুযোগ কোথায়। তবুও একদিন এ দুর্যোগ কেটে যাবে, রেখে যাবে অনেকগুলো প্রাণ হারানোর কান্না। তারপরও বিশ্ববাসী আশা করছে ধীরে ধীরে এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে ঘুরে দাঁড়াবে নেপাল। ভক্তপুরের শত উত্সব আর প্রাণপ্রাচুর্যের মিলনমেলায় হয়ত যাওয়ার সুযোগ হয়েছে অনেকেরই। ভক্তপুরকে এক কথায় পরিচয় করিয়ে দিতে সবাই বলে থাকেন এর ঐতিহ্যবাহী শিল্পকর্ম আর স্থাপত্যিক নিদর্শনের কথা। পাশাপাশি এখানকার স্থাপত্যগুলোর টেরাকোটা অলঙ্করণ, শৈল্পিক গবাক্ষ, অসাধারণ মন্দির ও সংলগ্ন পুকুর, স্থানীয় মানুষের সমৃদ্ধ আচারানুষ্ঠান, উত্সব, সঙ্গীত প্রভৃতি এর পরিচিতিতে দান করেছিল ভিন্ন রকম মাত্রা। আর আজ সবই ইতিহাস। তিব্বত ও ভারতের মধ্যবর্তী বাণিজ্যপথ হিসেবে এ স্থানের গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে ক্যারাভান রুটের উপস্থিতি একে অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যশালী করে তুলেছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক ও ইতিহাসবিদদের বিশ্বাস।
(Visited 19 times, 1 visits today)