এখনকার যুগে কবি-সাহিত্যিকরা আক্ষেপ করে বলতে পারেন বিশেষ সাহিত্য উপমা হারিয়ে যাওয়ার কথা। তাদের সাহিত্যচর্চার অন্যতম অনুষঙ্গ যদি হয় নারী, সেখানে মুখস্থ কিছু উপমা আছে যেমন— ‘পটোল চেরা চোখ’, ‘শাওন মেঘের মতো দীঘল কালো চুল’, ‘কৃষ্ণচূড়ার লালে লাল রক্তিম অধর’। যদি এখনকার যুগকে সেলফিনির্ভরতায় মাপা যায়, তবে নিজস্বী গ্রহীতা ছেলে কিংবা মেয়েদের সঙ্গে একটা উপমা সবচেয়ে ভালোভাবে খাপ খায়, তা হচ্ছে— ‘হাঁসমুখো’।
গ্রিক পুরাণ থেকে বাংলাদেশ! সেই নার্সিসাস থেকে আমাদের আসাদুজ্জামান রনি। পার্থক্যটা খুব বেশি কি? রূপের অহঙ্কারে অন্ধ যুবক নার্সিসাসের ওপর অভিশাপ ছিল প্রেমের দেবী ভেনাসের। কারণ হিসেবে পুরাণ বলছে, ছেলেটি নাকি কোনো মেয়েকেই তার যোগ্য মনে করত না। সেই অভিশাপে দগ্ধ যুবকের প্রাণ যায় একদিন ঝরনার জলে নিজের ছায়া দেখতে গিয়ে। পানিতে বিম্বিত নিজ মুখশ্রীরই প্রেমে পড়ে গিয়েছিল সে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে অপলক চেয়ে ছিল নিজ চেহারার দিকেই। অবশেষে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে একদিন মৃত্যু হয় তার।
ছোটকাল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুর পাঠ। কোনো একটা পর্বে পড়ে কিংবা কারো কাছ থেকে শুনে গ্রিক পুরাণে বর্ণিত নার্সিসাস নামের হতভাগ্য এ যুবকের কাহিনীটি কমবেশি অনেকেরই জানা। তবে তার সঙ্গে বাংলাদেশের আসাদুজ্জামান রনিকে মেলাতে হচ্ছে অনেক দুঃখভারাক্রান্ত হূদয়ে। নার্সিসাস পরিচ্ছন্ন পানিতে মরেছিল আত্মতুষ্টিতে বিভোর হয়ে। আর রনি পানিতে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়তে যাননি, তুলতে গিয়েছিলেন সেলফি। নীরস মধ্যদুপুরের গনগনে সূর্য দেখে রনির কী ইচ্ছা জেগেছিল কে জানে! তবে তালতলীর ট্যাংড়াগিরি ইকোপার্ক হয়ে গেছে এক জঘন্য ঘটনার সাক্ষী। সাহস করে রনি বিপত্সীমা প্রাচীর টপকে ভেতরে নেমেছিলেন। তারপর তাকে আক্রমণ করে পুকুরে টেনে নিয়ে যায় কুমির। সেখানেই মৃত্যু হয়েছে তার। পুরাণের যুগে হয়তো আয়না কিংবা সেলফি ক্যামেরা ছিল না। তাই নার্সিসাসের প্রাণ গিয়েছিল পানিতে নিজ বিম্ব দেখতে গিয়ে। আর এখনকার দিনে মানুষের প্রাণ যাচ্ছে সেলফি তুলে।
আবহমান বাংলায় গ্রামের মুরব্বিদের বড় বৈশিষ্ট্য— নিজের হাতে একটা ছাতা রাখতেন, বগলে থাকত চটি জোড়া। আর একটু বৃষ্টি কিংবা রোদের তীব্রতা বুঝতেই ঠাস করে ছাতা খুলে বসতে সময় লাগত না তাদের। বিশেষ করে সেলফোন কোম্পানির বিজ্ঞাপনের সূত্র ধরে জনৈক লেখক লিখেছিলেন, ‘দিন আসলেই বদলায়া গ্যাছে।’ আমরা একটু সতর্ক হলেই দেখতে পারি, দিন কীভাবে বদলে গেছে। আগের দিনে রোদ-বৃষ্টিতে ছাতা বের করা ছিল স্বাভাবিক। দিন বদলে গিয়ে এখনো ছেলেমেয়েদের ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের হয়। রোদ, বৃষ্টি কিংবা ঝড় লাগে না, তারা ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ঠাস করে ব্যাগ থেকে বের করে মেলে ধরে সেলফি স্টিক। বাস, রিকশা কিংবা প্রাইভেট কার, পথপাশ কিংবা প্রক্ষালন, মাছবাজার কিংবা শপিংমল, সমাধিক্ষেত্র নয়তো প্রার্থনাকক্ষ— ইচ্ছে হতেই সেলফি স্টিক বের করতে সময় লাগে না তাদের।
রনির মৃত্যু নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে আমাদের। কতটা বিকার ঘটলে মানুষ এগুলো করতে পারে ভাবা যায়! পরিবারের কোনো সদস্য অগস্ত্যযাত্রার অপেক্ষায় আইসিইউতে কিংবা সমাধিক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কারো শব, পেছন থেকে কোদাল-গাঁইতি নিয়ে দাঁড়িয়ে গোরখোদকরা; সেখানেও সেলফি তুলছে কেউ কেউ। এদিকে হজ করা কিংবা জুমার নামাজ পড়তে গিয়ে আর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে কবরখানায় সেলফি তোলার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। এ দেশে সেলফি তুলতে গিয়ে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর ঘটনাও মনে আছে অনেকের। এদিকে আত্মহননের আগে ফেসবুক লাইভে আসা কিংবা বিষের ডিব্বা, গলায় নেয়ার দড়িসহ সেলফি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করার ঘটনাও ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনা দিনের পর দিন মানুষের একাকী, নিঃসঙ্গ ও আত্মকেন্দ্রিক হওয়ারই প্রতিচ্ছবি। সময় হয়েছে সতর্ক হওয়ার, নয়তো আরো ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। রনি যেমন কুমিরের পেটে গেছেন, তেমনি এখন থেকে সচেতন না হলে আরো ভয়াল ভবিষ্যত্ গিলে খাবে প্রজন্মকে।