‘আমার যৌবনে তুমি স্পর্ধা এনে দিলে/তোমার দু’চোখে তবু ভূরুতার হিম।/ রাত্রিময় আকাশের মিলনান্ত নীলে/ছোট এই পৃথিবীকে করেছো অসীম।’ কায়ক্লেশে আটপৌরে জীবনের কথকতা যখন কালি ও কলমে মূর্ত হয়ে ওঠে, মনের অজান্তেই স্মরণে আসে প্রিয় কবি সুনীলের ‘একা এবং কয়েকজন’ কাব্যগ্রন্থের উপরের কয়েকটি লাইন। স্যামসন এইচ চৌধুরী, পাবনা জেলার কৃতিসন্তান, একজন সফল উদ্যোক্তা কিংবা চিকিত্সাসেবা ও ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশের অন্যতম পথিকৃত্। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, বেনাপোল থেকে তামাবিল দূরত্ব তো অনেক, কিন্তু সময় মনে রাখতে পারে এমন মানুষ আছেন ক’জন। আর থাকলেও তাঁদের সংখ্যা নিশ্চিত হাতে গোনা। স্যামসন চৌধুরীকে নিয়ে দু’কলম লিখতে গিয়ে শুরুতেই সুনীলের কবিতা ‘একা এবং কয়েকজন’ থেকে উদ্ধৃতি দেয়ার কারণটা কাকতালীয় না। দিনযাপনের নানা বাস্তবতাই তো ঠাঁই নেয় কবিতায়, আর সেটাই বিমূর্ত অভিজ্ঞানে মূর্ত হওয়া এক অতিলৌকিক অপরাবাস্তব। শুরুটা করেছিলেন স্যামসন চৌধুরী একাই, সঙ্গে ছিলেন কয়েকজন, বন্ধু ডা. কাজী হারুনুর রশিদ, ডা. পি কে সাহা ও রাধা বিনোদ রায়।
সাহস করে মাঠে নামার ক্ষমতা সবার থাকে না। নতুনত্বে অনেকের আগ্রহ থাকলেও চ্যালেঞ্জ নেয়ার সক্ষমতাটা সময়ের আবর্তে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিতে পারে। আর এখানেও তেমনি বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিলেন স্যামসন চৌধুরী এবং তাঁরা ক’জন। এখানে ব্যবসার শুরুতে তাঁদের চারজনের সম্মিলিত পুঁজি ছিল মাত্র ১৭ হাজার টাকা। তবুও সাহসে বলীয়ান হয়ে মাঠে নামা এ চার উদ্যোক্তা থেমে থাকেননি। সবার সমান অংশগ্রহণে আগামীর পথচলা মসৃণ করার রূপকল্পে তাঁদের কোম্পানিটি নাম পায় ‘স্কয়ার’। অনেকে নানা বিশ্লেষণ করেছেন এই নামকরণ নিয়ে। তবে বিভিন্ন দৈনিক থেকে প্রাপ্ত সূত্রে দেখা যাচ্ছে, কোম্পানির নামকরণ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে স্যামসন এইচ চৌধুরী স্বয়ং বলে গিয়েছিলেন পেছনের সত্যটা, ‘চারজনে মিলে এক নবযুগের সূচনা করার পথে পা বাড়িয়েছেন। তাই নামটা স্কয়ার রাখা হয়েছে। আর চারটি বাহু সমান এমন চিন্তা থেকেই স্কয়ার নাম দেয়া’। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, পরিকল্পিত বিনিয়োগ ও উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করায় মাত্র চার বছরের মাথায় মুনাফার মুখ দেখে স্যামসন এইচ চৌধুরীদের প্রতিষ্ঠান স্কয়ার।
শুরুতে অনেক পণ্য দিয়ে কারখানা যাত্রা করে এমন নয়। তবে স্কয়ারের কারখানার তৈরি ‘এস্টন সিরাপ’ দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে বাংলাদেশের বাজারে। মনে করা হয়, রক্ত পরিশোধনে অত্যন্ত কার্যকর হওয়ায় বাজারে ওষুধটির চাহিদা দ্রুত বাড়তে থাকে। তার পর গুণগত মানের কারণে মাত্র কয়েক বছরের মাথায় তা রফতানি শুরু হয়। বলতে গেলে এই ‘এস্টন সিরাপ’ থেকে আরো অনেক ওষুধ এতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি স্কয়ারকে। চার বন্ধুর প্রাণান্ত চেষ্টায় ছোট্ট লতাগুল্মের আদলে গড়ে তোলা স্কয়ার নামের প্রতিষ্ঠানটি একটা পর্যায়ে বিশাল বৃক্ষাকৃতি ছাপিয়ে রূপ নেয় মহীরুহে। একটা পর্যায়ে দেখা যায়, তাঁদের গড়ে তোলা সেই স্কয়ারই দেশের সর্ববৃহত্ ওষুধ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান। স্কয়ারের এ প্রাথমিক সফলতা প্রাণিত করে তাঁদের। একটা পর্যায়ে গিয়ে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে আরো অনেক ক্ষেত্রে সফল বিনিয়োগ শুরু করে স্কয়ার। এ গ্রুপের আওতায় রাজধানী ঢাকার পান্থপথে গড়ে ওঠা দেশখ্যাত হাসাপাতালটি এখন যেমন তাদের সফলতার অন্যতম প্রতীক, তেমনি সবমিলিয়ে ওই সময়েই আরো প্রায় ২৫টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সফল স্বপ্নদ্রষ্টা তিনি।
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে সফলতার অপর নাম যেমন স্কয়ার, তেমনি কনজিউমার খাতেও ধীরে ধীরে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক অবস্থান নিশ্চিত করতে যাচ্ছে স্কয়ার গ্রুপই। ভোক্তাদের কাছে স্কয়ারের অন্যতম ব্র্যান্ড ‘রাঁধুনী’ কিংবা ‘রুচি’ এখন আস্থার অপর নাম। সরিষার তেল থেকে শুরু করে রাঁধুনী ব্র্যান্ডে আছে প্রায় সব ধরনের মসলা। মরিচ, হলুদ, জিরা, ধনিয়ার গুঁড়া থেকে শুরু করে আছে বিভিন্ন ধরনের মিক্সড মসলার আইটেম। বলতে গেলে বিফ মাসালা, বোরহানি মাসালা, রাঁধুনী হালিম মিক্স, চটপটি মসলা, চিকেন মাসালা, কারি পাউডার, মাছের কারি মাসালা, গরম মসলা, কাবাব মসলা, মিট কারি মাসালা, মেজবানি বিফ মাসালা, পাঁচফোড়ন, রোস্টের মসলা কিংবা তেহারি মসলা বিক্রিতে পথিকৃত্ বলা যাবে স্করারকেই। বলতে গেলে তাদের সমান্তরালে আরো অনেক প্রতিষ্ঠান এখন বিকাশ লাভ করেছে বাংলাদেশে, যারা ভোক্তা চাহিদার কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন ধরনের মসলা বাজারজাত করছে। এদিকে ২০১৪ সালের দিকে স্কয়ার কনজিউমার প্রডাক্টস আত্মপ্রকাশ করে স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড হিসেবে। তাদের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের অধীনে রয়েছে অগণিত ভোক্তাবান্ধব পণ্য।
ওষুধের ডিসপেন্সারি থেকে শুরু করে মুদিদোকান— বাংলাদেশে এমন প্রতিষ্ঠান খুব কম রয়েছে যেখানে গেলে এখন স্কয়ার পণ্যের দেখা মেলে না। আকিজ গ্রুপের কর্ণধার সেখ আকিজ নিজ নামে প্রতিষ্ঠিত গ্রুপটির সব সাফল্যের পুরোভাগে যেমন ছিলেন, তেমনি স্কয়ারের সাফল্যের প্রায় পুরো কৃতিত্বই বর্তায় স্যামসন এইচ চৌধুরীর ওপর। তিনি নিজে থেকে কাজ শুরু করেছেন, উপযুক্ত সঙ্গ দিয়ে পথ করে দিয়েছেন নিত্যনতুন ব্র্যান্ড সৃষ্টির। বলতে গেলে মানুষের যা প্রয়োজন, যাপিত জীবনে মানুষ যেটা চায়, ঠিক সেই ধরনের পণ্যের জোগান দিতে পেরেছে বলেই আজ সফলতার আরেক নাম স্কয়ার গ্রুপ। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, বাংলাদেশের মধ্যে নিত্যনতুন অনেক ব্র্যান্ড আসে, যেগুলো জনপ্রিয়তা পায় ঠিক ওই সময়টায়। তার পর নির্দিষ্ট কালপর্ব পেরিয়ে হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলা যেতে পারে, হারিয়ে যাওয়ার জন্য স্কয়ার গ্রুপের ব্র্যান্ডিং করেননি স্যামসন এইচ চৌধুরী। এক্ষেত্রে গুণগত মানের উপযুক্ত অবস্থান ধরে রাখার পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে দেশের প্রতিটি প্রান্তে ভোক্তার দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে স্কয়ার গ্রুপের পণ্যগুলো। আবার আন্তর্জাতিক বাজারেও সুনামের সঙ্গে পণ্য রফতানি করছে স্যামসন এইচ চৌধুরীর আজন্ম লালিত স্বপ্ন থেকে বাস্তবে রূপ নেয়া বিশেষ প্রতিষ্ঠানগুলো।
একজন ব্যবসায়ী স্যামসন এইচ চৌধুরীর ব্যক্তি জীবনের বর্ণনা করতে গেলে সেটাও বহুবর্ণিল ও বর্ণাঢ্য এক অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। বাবার পেশাগত কারণে তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। সেই দখিন দুয়ারের চাঁদপুর থেকে উত্তরের শহর পাবনা এমনকি ময়মনসিংহ পর্যন্ত নানা স্কুলে পড়তে হয়েছে তাঁকে। তার পর একটা পর্যায়ে এসে ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতার এক স্কুলে। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে তিনি কলকাতা থেকে চলে এসেছিলেন পাবনায়। সেখানে আতাইকুলা স্কুল থেকেই শেষ করতে হয়েছিল তাঁর প্রবেশিকার পাঠ। পরিবারের মত উপেক্ষা করেই কিশোর স্যামসন এইচ চৌধুরী চলে গিয়েছিলেন মুম্বাইয়ে। নিজ যোগ্যতা, দক্ষতা ও আন্তরিকতার গুণে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যোগ দিয়েছিলেন রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভিতে। এখানে থেকেই তিনি অংশ নিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। নৌবাহিনীতে থাকাকালীন বিভিন্ন প্রযুক্তিগত শিক্ষা বেশ টানত তাঁকে। একটা পর্যায়ে নৌবাহিনীর ‘রাডার বিভাগের’ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে মাত্র তিন বছরের মাথায় আবার ফিরে আসেন পাবনায়। এবার তিনি যোগ দেন পোস্ট অফিসের কর্মকর্তা হিসেবে।
পুরোদস্তুর একজন ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন যাঁকে তাড়া করে ফিরছে সেই শৈশব থেকে, তাঁর পক্ষে কোনো সাধারণ চাকরিতে সন্তুষ্ট থাকা অসম্ভব। তিনি স্বপ্ন বাস্তবায়নে সব ধরনের ছাড় দিতে চেয়েছিলেন। একটা পর্যায়ে এসে শিক্ষা ও চাকরি জীবনের বারবার বদল থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতাই বৈচিত্র্য এনেছিল তাঁর চিন্তায়। বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে আহরিত তথ্য আর দায়িত্বের বৈচিত্র্য তাঁকে করে তোলে আরো স্বাপ্নিক ও উদ্যমী। একটা পর্যায়ে তাঁর অভিজ্ঞতার অনুষঙ্গে স্কয়ার গ্রুপ হয়ে উঠেছে প্রবাদতুল্য একটি একটি ব্র্যান্ড নাম। স্যামসন এইচ চৌধুরী হয়েছেন বাংলাদেশের সব উদ্যোক্তার মধ্যে পথিকৃত্ এক নাম। এদিকে বাংলাদেশী উদ্যোক্তাদের যে বদভ্যাস, সেটাকে অতিক্রম করার ক্ষেত্রেও প্রশংসা কুড়াতে পারেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। অন্তত শিল্প বিকাশের নামে তিনি রাষ্ট্রকে ঠকিয়ে আখের গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করেননি। উপযুক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি তিনি অতিমুনাফা ও খেলাপি ঋণের জাল ছিঁড়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন কাঞ্চনজঙ্ঘার উচ্চতায়। তাই তিনি বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বিকাশে যেমন এক পথিকৃত্, তেমনি স্বদেশী উদ্যোক্তাদেরও অগ্রপথিক। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন থেকে তরুণ উদ্যোক্তারা শিক্ষা নিলে অন্তত দেশ থেকে কমবে বেকারত্বের অভিশাপ, হতাশ কর্মবিমুখ মানুষগুলো হবে কর্মচঞ্চল ও প্রাণবন্ত।