সাভারের রানা প্লাজা থেকে ঢাকার নিমতলী— যানজটের শহর হিসেবে দূরত্বটা অনেক। তবে ভয়াবহ হতাহতের সংখ্যা বিচার করতে গেলে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। নিমতলী থেকে এবার চুড়িহাট্টা, দশক পেরোনোর আগেই আরেক দফা অগ্নিকাণ্ড। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের লেলিহান শিখায় অঙ্গার হয়ে গেছে এখন পর্যন্ত আশির কাছাকাছি প্রাণ। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের কাছে সারি বেঁধে সাজিয়ে রাখা মরদেহ দেখে অশ্রুজলে সিক্ত মানুষগুলোও হয়তো বুঝতে পারছে না, কী এক নারকীয় তাণ্ডব বয়ে গেছে চুড়িহাট্টায়! দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া একটা গাড়ির কাছে ঝলসে যাওয়া পা, বাঁকা হয়ে যাওয়া চাকা আর অবয়ব থেকে বোঝা যায় রিকশার মতো দেখতে একটা বস্তু, সেখানেও ভেজা কাপড়ে ঢেকে রাখা হয়েছে তিন-তিনটা মরদেহ। বোঝা যায় রিকশার দুই আরোহীর সঙ্গে অঙ্গার হয়ে গেছেন তার চালকও। তবে স্থানীয়দের ভাষ্য, এ রিকশায় যাচ্ছিল এক দম্পতি এবং তাদের শিশুসন্তানটি। পুরোপুরি পুড়ে গিয়ে ভুতুড়ে রূপ নেয়া চুড়িহাট্টার ধ্বংসস্থলে দাঁড়ালে সবার মনে পড়বে নিমতলীর কথা। ২০১০ সালের ৩ জুন। সন্ধ্যার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি সেদিনের ওই লেলিহান শিখা নেভাতে পারেনি। স্থানীয় একটি গুদামে রাখা রাসায়নিকের আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল সেদিনের নিমতলী। বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গিয়েছিল, ওই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ১২৪ জন। ক্ষণিকের তাণ্ডবে গোরস্তানে রূপ নেয় ঘনবসতিপূর্ণ নিমতলীর ওই এলাকা।
২০১০ সালের ৩ জুন দুর্ঘটনায় যখন সবাই চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা মরদেহগুলো দেখেছিল, হয়তো শয়নে-স্বপনে-প্রার্থনায় একটাই আর্জি হয়ে উঠেছিল, এমন অঘটন আর না আসুক ঢাকাবাসীর জীবনে। নাগরিক অধিকারের কথা থোড়াই জ্ঞান করে পুরান ঢাকার নানা স্থানে অগোছালো গলিপথের সংকীর্ণ ঘিঞ্জি এলাকায় গড়ে উঠতে দেখা যায় শত শত কারখানা। এমন অপরিসর গলির ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাসায়নিক ব্যবসা তো বটেই, শিল্প-কারখানা স্থাপন যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা আট বছর আগের নিমতলী তাণ্ডবে দেখেছিল দেশবাসী। তবে এ অঘটন আর প্রাণহানি শুধু কয়েকদিন অশ্রু ঝরিয়েছে, তার থেকে শিক্ষা নিতে পারিনি আমরা। সরকারের কাজ তখন সরকার করেছিল। কিন্তু দুর্বৃত্তদের রুখতে পারে সাধ্য কার! ভয়াবহ নিমতলী দুর্ঘটনার পর তালিকা করে ৮০০ রাসায়নিক গুদাম ও বিপজ্জনক কারখানাকে পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে আরেক প্রান্তে কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। অসাধু চক্রের নানা হুমকি-ধমকি, গড়িমসি আর ব্যক্তি-গোষ্ঠীস্বার্থের কাছে হার মেনেছে সরকারের ওই শুভ উদ্যোগ। শেষ পর্যন্ত একই ভয়াবহতার পুনরাবৃত্তি। বিভিন্ন দৈনিকের খবরে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকলেও মরদেহ গণনা এখনো শেষ হয়নি।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত মহান একুশের প্রভাতফেরিতে অংশ নেয়ার জন্য ভোরের আলো ফুটতেই বাসা থেকে রওনা হয়েছি। পথিমধ্যে স্মার্টফোনের স্ক্রিনে একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইন পাতায় পড়লাম— ‘রাজধানীর চকবাজারে রাজ্জাক ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ৬৫ জনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৭ জন পুরুষ। পাঁচজন নারী। তিনজন শিশু। নিহত ব্যক্তিদের পরিচয় সকাল সাড়ে আটটায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জানা যায়নি। অগ্নিদগ্ধ ১০ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। অগ্নিদগ্ধ কয়েকজন মিটফোর্ড হাসপাতালে ও কয়েকজন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন।’ হুট করে স্মৃতির আয়নায় গিয়ে প্রচণ্ড আঘাত লাগে। অজান্তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল। তখন আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। খুব সম্ভবত একটা টিউটোরিয়াল পরীক্ষা ছিল সেদিন। সাতসকালে ঢাকা থেকে রওনা হলেও ক্যাম্পাসে পৌঁছনো হয়নি আর। সাভার বাজারের সঙ্গে প্রায় লাগোয়া রানা প্লাজা ধসে পড়েছিল সকাল সাড়ে ৮টা থেকে পৌনে ৯টা নাগাদ। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আগে থেকে নিষিদ্ধ হলে শ্রমিকরা সেখানে প্রবেশে সায় দেননি। তবু তাদের চাকরিচ্যুতির হুমকি দিয়ে হ্যান্ডমাইকে ডেকে ডেকে ঢোকানো হয়েছিল সেদিনের মৃত্যুকূপে। বলতে গেলে প্রায় চোখের সামনে দেখেছি রানা প্লাজার এই কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড।
ক্রিকেটের স্কোরবোর্ডে রান উঠতে থাকলে তো সবারই ভালো লাগে। তাই বলে যত যাই হোক, সেখানে উপস্থিত যারা অধরচন্দ্র স্কুলের বারান্দার কাছে বসানো মরদেহের স্কোরবোর্ড দেখেছেন, ওই দিনটি ভুলে যেতে চাইবেন নিঃসন্দেহে। ক্লাস-পরীক্ষার চিন্তা বাদ দিয়ে দৌড়ে ঢুকেছিলাম সেদিনের রানা প্লাজায়। একটু পর খেয়াল করে দেখলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বন্যার তোড়ে বাঁধ ভেঙে আসা পানির মতো ছুটে আসছেন শিক্ষার্থীরা। তারপর শবযাত্রার সেই মিছিলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে সেনাবাহিনী, পুলিশ, শিক্ষার্থী আর সাধারণ মানুষ। প্রচেষ্টা প্রার্থনায় তখন একটাই সুর, একটাই চাওয়া— এমন ঘটনা আর ফিরে না আসুক। কিন্তু ঘুরেফিরে এমন অঘটনই হয়ে যাচ্ছে আমাদের নিত্যসঙ্গী। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারেনি বলে পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু হয়ে গেছে অনেকটাই স্বাভাবিক। কারখানা মালিকদের ভাবখানা এমন যে শ্রমিকদের জন্মই হয়েছে মরার জন্য, তারা দু-একজন মারা গেলে তেমন কিছুই এসে যায় না; বরং নতুন শ্রমিক এসে যায় দ্রুতগতিতে।
মৃত্যুতাণ্ডবের ধোঁয়া উঠেছে চুড়িহাট্টায়। এটি ২০১০-এ ঘটে যাওয়া নিমতলীর পুনরাবৃত্তি। রিকশা থেকে ভ্যান কিংবা কার, বাদ পড়েনি কিছুই। ২০-২৫টি পোড়া রিকশার কাঠামো ছড়িয়ে ছিটিয়ে চারপাশে। একটি দৈনিকে প্রকাশিত ছবি থেকে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে দুটি পিকআপ ভ্যান, দুটি প্রাইভেটকার, কয়েকটি মোটরসাইকেল ও অটোরিকশার কাঠামো। বোমারু বিমান থেকে আক্রমণ চালালে যেমন দশা হয়, তেমনি এ ধ্বংসস্তূপ থেকে নানা স্থান থেকে ভয়াবহ ধোঁয়া উঠছে। আর অশ্রুঝরা চোখ নিয়ে আত্মীয়স্বজনরা আতিপাতি করে এর মধ্যেই খুঁজছেন প্রিয়জনের মরদেহ নামের অঙ্গার। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে স্থানীয় মানুষ। তারা মরদেহের অংশবিশেষ পেলে সেটা মসজিদ থেকে সুতি কাপড় ভিজিয়ে এনে ঢেকে দিচ্ছে।
প্রচলিত প্রবাদে চোর পালানোর পর নাকি বুুদ্ধি বাড়ে। আসলে বুদ্ধি কমে-বাড়ে যা-ই হোক, কোনো ক্ষয়ক্ষতির পর সেখানে বিদ্যমান ত্রুটি নিয়ে নানা কথা নানাজন বলতে পারেন। চুড়িহাট্টার দুর্ঘটনাস্থল থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন পুড়ে যাওয়া মানবদেহের অবশিষ্টাংশ খুঁজে বেড়াচ্ছেন, ঠিক তখনই বিভিন্ন দৈনিকের অনলাইন ভার্সন থেকে পাওয়া যাচ্ছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য। তবে সবাই কমবেশি যেটি জানে তা হচ্ছে, চকবাজারের এ এলাকা বিখ্যাত হয়েছে নানা প্রসাধনী ও প্লাস্টিকপণ্য তৈরির কাঁচামাল বিক্রিবাট্টার কারণে। আমার জনৈক ম্যাজিস্ট্রেট বন্ধুর কাছ থেকে শুনেছিলাম, তারা নাকি এ এলাকায় বেশ কয়েকবার রেইডও দিয়েছে নকল প্রসাধনী বিক্রির অভিযোগে। বাংলাদেশের নানা স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে আসতেন খুব কম দামে নকল প্রসাধনী কিনে নেয়ার জন্য। বিশেষ করে চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডস্থল রাজ্জাক ভবনের মধ্যেও দাহ্য রাসায়নিক রাখার গুদাম ছিল বলে অনেক আগে থেকেই সবার জানা। দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ পেয়েছে, চুড়িহাট্টা মসজিদের উল্টো দিকের বাড়িটির বেজমেন্টসহ একতলা ও দোতলায় ছিল আসল-নকল সুগন্ধির বিশাল মজুদ। এ সুগন্ধির বোতলগুলো ভয়াবহ দাহ্য পদার্থে পরিপূর্ণ ছিল। ভয়াবহ ঘটনা হচ্ছে, আগুন লাগার প্রকৃত কারণ কেউ বলতে পারছে না। বিশেষত এ সুগন্ধির গুদাম থেকে আগুন গিয়ে পুরো রাস্তাকে গ্রাস করেছে, নাকি রাস্তার আগুন ছুটে গিয়ে ওই কারখানায় লেগেছে, এ নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী ও সংবাদকর্মীদের রয়েছে ভিন্ন মত। কেউ কেউ একটি প্রাইভেটকারের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে মনে করলেও ঘটনাস্থলে যে দুটি গাড়ি দেখা যায়, তার একটির সিলিন্ডার অক্ষত অবস্থায়ই রয়েছে। অন্যদিকে তার পাশে যে হাইব্রিড টয়োটা অ্যাকুয়া গাড়িটি দেখা যায়, তার ভেতরে কোনো সিলিন্ডার ছিল না।
নিমতলী, রানা প্লাজা কিংবা তাজরীন ফ্যাশনসের দুর্ঘটনায় পুরো জাতি আঁতকে উঠলেও শেষ পর্যন্ত এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায়নি। সাময়িক শোকের ছায়া ধীরে ধীরে দীর্ঘায়িত হয়, তারপর সেই শোকের ছায়াকে গ্রাস করে নিচ্ছে আরো বড় কোনো শোক। শেষ পর্যন্ত এমন দুর্ঘটনা কিংবা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডে শব মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতম হচ্ছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, পুরান ঢাকার আরো অনেক এলাকায় এমনভাবে অপরিসর গলিপথের কোথাও রয়েছে শত শত রাসায়নিকের মজুদ। নানা স্থানে দাহ্য পদার্থের কারখানায় নিশ্চিন্তমনে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে শ্রম দিচ্ছেন শ্রমিকরা কিংবা এমন নানা বিপজ্জনক স্থানের লাগোয়া কোনো দেয়ালে ছোট্ট টং ঘরে ভাজা হচ্ছে শিঙ্গাড়া-সমুচা কিংবা বিক্রিবাট্টা চলছে গরম চা-কফির। ফলে সেখান থেকে কোনো একদিন আবারো এমন দুর্ঘটনার শঙ্কা যে রয়েছে, তা অনেকটা নিশ্চিত করে বলা যায়। চুড়িহাট্টার এ অগ্নিকাণ্ডে হতাহত মানুষগুলোর ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। মহান সৃষ্টিকর্তা তাদের শোকতপ্ত পরিবারকে ধৈর্য ধরার শক্তি দিন। পাশাপাশি এ ধরনের দুর্ঘটনা ভবিষ্যতে যাতে না হয়, সে ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে এখনই। কেউ কেউ বলতে পারেন, দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই, এর থেকে মুক্তির পথ নেই। সেক্ষেত্রে বলতে হয়, দুর্ঘটনা থেকে মুক্তির পথ না থাকলেও আগে থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা গেলে কিছু না হোক, তার ক্ষয়ক্ষতি আর প্রাণহানি কমিয়ে আনা সম্ভব বহুলাংশে। তাই আমরা দুর্ঘটনা প্রতিরোধ না-ইবা করতে পারি, তবে এটা অন্তত নিশ্চিত করার চেষ্টা চালাই, যাতে অবকাঠামোগত কোনো দুর্বলতা ও পরিকল্পনার অভাবে এমন প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা আর না ঘটে।