পত্রমোচী বৃক্ষের ঝরে পড়া পাতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্লান্ত নরদেহগুলোও যেন ঝরে পড়তে চায়। বলতে গেলে এমনই তপ্ত ক্ষণে গিয়েছিলাম ধামরাইয়ের মাঠকর্মে। সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে ঢাকা থেকে ধামরাইয়ের উদ্দেশে যাত্রা। এই ভেবে বাসে চেপেছিলাম, যেন দাবদাহ একটু হলেও কম স্পর্শ করে। কিন্তু এটুকু পথের যাত্রায় ঘেমে-নেয়ে একাকার। প্রচণ্ড উত্তাপে প্রাণ বেরিয়ে আসার দশা। তখন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি মাঠপর্যায়ের প্রত্নতাত্ত্বিকদের সঙ্গে রোদের চিরস্থায়ী বৈরিতার কথা। যদিও রোদ বরাবরের মতো সাত আসমান থেকে আগুন ঝরিয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে অনেকটা পাল্লা দিয়েই শেষ করতে হয়েছে মাঠকর্ম। বলতে গেলে প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য থেকে ধামরাইয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই দৃষ্টি কাড়ে সবার। ঔপনিবেশিক সময়ের বাড়িগুলো নিবন্ধন করা মূল উদ্দেশ্য হলেও এর আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ হেলায় হারাতে চাইনি। তাই ধামরাই ভ্রমণের বেশির ভাগ সময় ক্যামেরাটা সচল ছিল।
ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের নিরন্তর গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, বাংলাদেশের রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। ইতিহাসের প্রাচীনত্বের তুলনায় ধামরাই উপজেলা তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে নাও হতে পারে।
বিশেষ করে বংশী, ধলেশ্বরী, রাঙ্গামাটি অববাহিকার নতুন ভূমিরূপের ধামরাইয়ে হাজার বছর পূর্বে গড়ে ওঠা পাথর যুগের সংস্কৃতি বা তাম্রপ্রস্তর সংস্কৃতির অস্তিত্ব কল্পনা করাটাও অবাস্তব। তবে ঐতিহাসিক সময় থেকে বিচার করা হলে ধামরাই উপজেলায় সমৃদ্ধ ইতিহাসের দেখা মেলে, যা রাজধানী ঢাকা ও তার আশপাশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বিশেষ করে প্রাক-মোগল ও মোগল যুগের পর থেকে এ অঞ্চলে একটি সমৃদ্ধ মানববসতি গড়ে উঠেছিল, এমন কথা অনেক ইতিহাসবিদ উল্লেখ করেছেন। তার পর ঔপনিবেশিক সময়কালে নীল চাষ ও জমিদারকেন্দ্রিক অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছিল এখানে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এ অঞ্চলের বীর সেনানীরা। এসব দিক থেকে বিবেচনা করতে গেলে ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে ধামরাই উপজেলা।
ঢাকা জেলার ২৬৬ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ স্থান ইতিহাস-প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যে যথেষ্ট সমৃদ্ধ। এখানকার বেশকিছু প্রত্ন-ইমারত নানা সময়ের ধ্বংসলীলা উপেক্ষা করে জরাজীর্ণ অবস্থায় এখনো টিকে আছে। এর মধ্যে মঠ, মন্দির, মসজিদ ও সমাধি, নীলকুঠি এবং আবাসিক ভবন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এর কিছু কিছু আধুনিক কালে সংস্কার করা হলেও বেশির ভাগই অরক্ষিত অবস্থায় মানববসতি সম্প্রসারণ ও কৃষিজমি বিস্তারের ফলে ধ্বংসের দিকে চলেছে। আর মসজিদ-মন্দিরগুলো বহুবার সংস্কারের ফলে এর আদিরূপ হারিয়ে গেছে। তবে এগুলো এখনো ব্যবহার হওয়ায় কোনো রকমে টিকে আছে। দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে মুসল্লিদের সংখ্যা বাড়ার কারণে মসজিদগুলোকে ভেঙে বৃহদাকার নতুন মসজিদে রূপান্তর করতে দেখা যায়।
অন্যদিকে আকাশচুম্বী মন্দির ও মঠগুলো গাঠনিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল হওয়ায় ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে। ফলে আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় ইতিহাসের অমূল্য সাক্ষী প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো। ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে গেলে পাওয়া যায় ঔপনিবেশিক বাংলায় স্থাপত্য, বাণিজ্য, শিল্পচেতনায় যে এলাকাগুলো সমৃদ্ধি লাভ করেছিল, এর মধ্যে ঢাকার ধামরাই উপজেলা অন্যতম। এখানে অনেক গবেষক নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা করলেও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও স্থাপত্য নিয়ে গবেষণা হয়েছে খুব কম। পক্ষান্তরে এ অঞ্চল চটজলদি ভ্রমণের জন্য ঢাকার মানুষের আদর্শ স্থান হতে পারে। রাজধানীর উপকণ্ঠে অবস্থিত নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এ এলাকার প্রাকৃতিক দৃশ্য আর ঐতিহ্যকে সবার মাঝে পরিচিত করানোটা এখন সময়ের দাবি।