ব্ল্যাক ডেথের মৃত্যুর মিছিল স্তিমিত হয়ে আসতেই আরেকদফা বড় রকমের মহামারীর মুখোমুখি হয় বিশ্ব। ভয়াবহতা ও প্রাণহানির হিসেবে ব্ল্যাক ডেথের থেকেও একে এগিয়ে রাখতে হয়। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ভয়বহতম এ রোগের সংক্রমণও সৃষ্টি করেছিল ইউরোপীয়রাই। তারা ভৌগেলিক আবিষ্কারের পর উপনিবেশ ও বাণিজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এ সময় তাদের মাধ্যমে আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়া এ মহামারী সেখানকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রায় ৯০ শতাংশের প্রাণহানির কারণ হয়েছিল। ১৫২০ সালের ৫ মার্চ যখন স্পেন থেকে যাওয়া ছোট্ট জাহাজটি কিউবা থেকে মেক্সিকোতে গিয়ে নোঙ্গর করে কেউ অনুমান করতে পারেনি বিশ্ব সভ্যতার জন্য কতবড় বিপদ অপেক্ষা করছে। লাতিন আমেরিকার দেশগুলো দখল করার চেষ্টা স্পেন অনেকদিন আগে থেকেই করে আসছে। তারা চেয়েছিল এবার বড় রকমের না হলেও সাধারণ আক্রমণ ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে। অশ্বারোহী, গোলন্দাজ এবং আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা দাসদের সমন্বয়ে তাদের ৯০০ জনের এই বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। তাদের একজন দাস ফ্রান্সিকো দ্য এগুইয়ার (ঋৎধহপরংপড় ফব ঊমঁল্পধ) নেতৃত্বে আসা দলটি নিয়ে আসে ভয়াবহ গুঁটি বসন্তের জীবাণু।
পারমাণবিক বোমার মতো ভয়াবহ হয়ে ওঠে গুঁটি বসন্তের প্রভাব। এগুইয়ার জাহাজ মেক্সিকো উপকূলে নোঙ্গর করার অল্পদিনের মধ্যে আঁচ করা এই মহামারীর ভয়াবহতা। মেক্সিকোতে নামার পর এগুইয়ার শরীরে সামান্য র্যাশ হিসেবে দেখা দেয়ার পর তা অল্প সময় সময় ব্যবধানে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তাকে চিকিৎসার জন্য একজন আদিবাসী আমেরিকান পরিবারের সাহায্য প্রার্থনা করা হয়। সিম্পোলান শহরের এই আদিবাসী পরিবারটি প্রথম আক্রান্ত হয়। তারপর তাদের মাধ্যমে আশেপাশের আরো অনেক মানুষের মধ্যে বিস্তার ঘটে ভয়াবহ এ রোগের। বলতে গেলে মাত্র দশদিনের ব্যবধানে পুরো সিম্পোলন শহর একটি গোরস্তানের রূপ নেয়। বাইরে থেকে সিম্পোলানে আসা লোকগুলো এই রোগ তাদের শহরে নিয়ে যায়। এর আগে বিশ্ববাসী প্লেগের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছে। এবার এমন একটা রোগের মুখোমুখি যা তারা আগে দেখেনি। তবে এর প্রকোপে যে কান্নার রোল ওঠে মেক্সিকোর আশেপাশে শেষ পর্যন্ত তা থমকে দাঁড়ায় ভয়াবহ এক মৃতুমিছিলে গিয়ে।
গুঁটিবসন্ত ছড়িয়ে পড়ার ঐ সময়ে মায়া অঞ্চলের মানুষ তিন অপদেবতায় বিশ্বাস করতো। তাদের হিসেবে যত রোগ শোক, ফসলের ক্ষতি কিংবা গজবের উৎপত্তি হয় একপেজ, উজাঙ্কাক এবং সোজাকাক এই তিন দেবতার কারণে। তাদের মতো আজটেকদের বিশ্বাসে মনে করা হতো তেজকাটালিপোক্যা এবং জাইপে নামের দুই দেবতার ইচ্ছেতেই সব রোগ ছড়ায়। তবে মায়া এবং আজটেকরা প্রত্যেকেই যেটা বিশ্বাস করতো সেটা হচ্ছে সাদা চামড়ার মানুষের কালো জাদু কিংবা শয়তানি। ইউরোপের নানা দেশের মানুষ গিয়ে মায়া ও আজটেকদের নানা জনপদে ঘাঁটি তৈরির পর থেকে শুধুই আবিবাসী আমেরিকানদের ক্ষতি করতে দেখেছেন স্থানীয় মানুষ। ফলে তাদের পক্ষে ইউরোপীয়দের নিয়ে ভাল কোনো ধারণা করা কঠিন ছিল। এগুইলার শরীর থেকে সিম্পোলানের মানুষ একের পর এক আক্রান্ত হতে শুরু করলে ডাক্তার এবং যাজকরা মিলে আলোচনা করে। তারা প্রথম দিকে কোনো ধরণের সমাধান খুঁজে পাননি। পরে এই রোগের থেকে মুক্তির জন্য তারাও সমবেত প্রার্থনার কথা বলে। পাশাপাশি ঠাণ্ডা পানিতে স্নান, বিটুমিন তথা আলকাতরা দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে দেয়া কিংবা পাতপাতা বেঁটে আক্রান্ত চামড়ায় প্রয়োগের কথাও বলা হয়।
নতুন আক্রান্ত হওয়া রোগ সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞাত থাকা নেটিভ আমেরিকানরা এর প্রতিরোধে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে পুরোপুরি অক্ষম ছিল। অন্যদিকে চিকিৎসার নামে তারা যেটা করেছিল তার ফলাফল হয়ে ওঠে ভয়াবহ। একাধারে ডাক্তার এবং রোগী প্রত্যেকেই ভুগতে থাকে নতুন রোগে আক্রান্ত হয়ে। মাত্র কয়েকটি দিনের ব্যবধানে চারপাশে ওঠা কান্নার রোল একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে যায় যখন হাজার দশেক শবদেহ রাস্তার পাশে পড়ে থেকে তাতে পচন লাগে। তখন লাতিন দেশগুলোতে এমন কাউকে পাওয়া যায়নি যে এই লাশগুলো দাফন-কাফনের জন্য এগিয়ে আসে। ফলে একটা সময়ে এসে ঐ এলাকায় বিরাজমান গোরস্তানের নীরবতা ছত্রখান হয়ে যায় লাশখেকো শকুনের আগাগোণায়। অল্পদিন ব্যবধানে একটি পরিবারের প্রায় সবাই লাশ হয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দেয় বাড়ির ছাদ ধ্বসিয়ে দিয়ে লাশ ঢাকার জন্য। বলতে গেলে কিছু জনবসতির প্রায় অর্ধেক মানুষ এই মহামারীর মুখে পড়ে মরে ভূত হয়ে যায়।
আড়াই লাখের মতো মানুষ নিয়ে ছিমছাম সাজানো গোছানো শহর আজটেকদের রাজধানী তেনোচ্ছেৎলান। ১৫২০ সালের অক্টোবর মাস পার করার আগে এই সমৃদ্ধ নগরীর কেউ জানতে পারেনি কি রকম ভয়াবহ এক মৃত্যুর নগ্নতা-ব অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। আজটেক রাজা কুইতেলহুয়াক (ঈঁরঃষপ্সযঁধপ) থেকে শুরু করে তিনভাগের একভাগ মানুষ মারা পড়ে স্প্যানিশদের বয়ে আনা প্লেগের প্রথম ধাক্কাতেই। স্পেন থেকে মৃত্যুদূতের মতো প্লেগের জীবাণুবাহী জাহাজটি উপকূলে নোঙ্গর করার আগে ১৫২০ সালের মার্চেও মেক্সিকো ছিল ২.২ কোটি মানুষের বসতিস্থল হিসেবে সমৃদ্ধ একটি দেশ। মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাত্র এই কয়েকটি মাসের মৃত্যুতা-বে সেখানে টিকে থাকে মাত্র ১.৪ কোটি মানুষ। ইউরোপ থেকে আসা উপনিবেশবাদীদের পক্ষ থেকে প্রথম ধাক্কা ছিল গুঁটি বসন্ত। এর বাইরে স্পেনের ঔপনিবেশিক শক্তি নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে গিয়ে নারকীয় অত্যাচার ও লুণ্ঠন চালায় মেক্সিকোতে। মহামারী জর্জরিত মানুষের কাছে তা আদতে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘাঁ হয়ে দেখা দেয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম এবং আরও কয়েকটি প্রাণঘাতী রোগ একের পর এক আক্রান্ত করে মেক্সিকোবাসীকে যার ফলাফল হিসেবে মাত্র ৬০ বছরের ব্যবধানে ১৫৮০ সালে গিয়ে মেক্সিকোর জনসংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র ২০ লাখে।
সুন্দর সাজানো গোছানো মেক্সিকোর রাজধানী তেনোচ্ছেৎলান থেকে শুরু করে পুরো দেশকেই শুয়োরের কচু খোঁড়ার মতো করে মাড়িয়ে দিয়েছিল বিচিত্র সব মহামারী বহনকারী স্প্যানিশরা। এ দেশটির সর্বনাশ করার পর ইউরোপের উপনিবেশবাদী শক্তি গিয়ে হামলে পড়েছিল হাওয়াই দ্বীপেও। ১৭৭৮ সালের ১৮ জানুয়ারি হাওয়াইবাসীর জন্য ক্যালেন্ডারে লাল দাগ দিয়ে রাখার দিন। ব্রিটিশ জাহাজের ক্যাপ্টেন জেমস কুক তার বাহিনী নিয়ে হাওয়াই উপকূলে জাহাজ নোঙ্গর করে। এর আগে আমেরিকা থেকে শুরু করে ইউরোপ এবং বিশ্বের প্রায় সব থেকে বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপদেশ প্রকৃত অর্থেই এক শান্তির নীড় ছিল। সেখানে সবমিলিয়ে প্রায় ৫ লাখের মতো মানুষ বাস করতো। তারা এর আগে আমেরিকার অন্য অঞ্চল কিংবা ইউরোপের মতো কোনো মহামারীর তোপের মুখে পড়েনি। ক্যাপ্টেন কুক তাদের জন্য তেমন কিছু নিয়ে যেতে না পারলেও ইনফ্লুয়েঞ্জা, যক্ষা এবং সিফিলিসের মতো রোগের সঙ্গে পরিচিত হয় তারা। ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং যক্ষার মতো সংক্রামক রোগের বাইরে জাহাজের নাবিকদের যৌনক্ষুধার শিকার হওয়া নারীদের মাধ্যমে একের পর এক সিফিলিস আক্রান্ত হতে থাকে স্থানীয় মানুষ। অল্পদিন ব্যবধানে ক্যাপ্টেন কুকের লেজ ধরে খেঁকি কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকতে শুঁঁকতে ইউরোপ থেকে হাওয়াইয়ের মাটিতে পা রাখে আরেক পাল উপনিবেশবাদী। এবার তারা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল টাইফয়েড এবং গুঁটিবসন্ত। ফলে ১৮৫৩ সালের দিকে এসে দেখা যায় হাওয়াইয়ের পূর্বতন জনসংখ্যা থেকে সিংহভাগ গায়েব হয়ে গিয়ে টিকে আছে ৭০,০০০ এর মতো মানুষ।