গুপ্তগোষ্ঠী সিরিজের প্রথম গ্রন্থ ‘ফ্রিম্যাসনারির’ দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের পূর্বে আমি আমার প্রথম সংস্করণের সকল পাঠকের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। তথ্যবিচ্যুতি, বিশ্লেষণজনিত জটিলতা এবং সহায়ক তথ্যসূত্রের স্বল্পতা বিশেষভাবে প্রথম সংস্করণে লক্ষ্য করা যায়। দ্বিতীয় সংস্করণে এই ধরণের সব জটিলতা থেকে উত্তরণের মাধ্যমে গ্রন্থটিকে পূর্ণাঙ্গকরণের চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়, ‘গুপ্তগোষ্ঠী ফ্রিম্যাসনারি কথা’ বইয়ের পাণ্ডুলিপি যখন লিখেছি তখন আমি কেবল স্নাতক দ্বিতীয়বর্ষে পড়ি। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে স্কুলজীবন তো বটেই, সেই ক্লাস ফোর-ফাইভ থেকে বিচিত্র পাঠাভ্যাসের কারণে অনেক বই পড়া হয়েছে। কিন্তু একটা ইতিহাস বিষয়ক বস্তুনিষ্ঠ ও নির্মোহ বই লিখতে গেলে যে যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন সেটা একজন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীর থাকার কথা নয়।
অন্যদিকে ইতিহাস অতীতের তথ্যনির্ভর বর্ণনা। এই বর্ণনা সাধারণভাবে বলা গেলেও তা লিখে প্রকাশ করা যায় না। এর জন্য দীর্ঘ প্রচেষ্টা, বিশ্লেষণী শক্তি এবং উপযুক্ত অনুধাবন প্রয়োজন। ফলে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের শুরুতেই আমি নিজের সীমাবদ্ধতা উল্লেখ পূর্বক ‘গুপ্তগোষ্ঠী ফ্রিম্যাসনারির কথা’ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের প্রত্যেক পাঠকের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে নিলাম। যাঁরা অর্থলগ্নি করে বইটির প্রথম সংস্করণ কিনে পড়েছেন তাঁদের টাকা ফেরত দেওয়ার সামর্থ আমার নেই। তবে দ্বিতীয় সংস্করণ পড়তে বসলে ইনশাআল্লাহ তাঁরা সব বিরক্তির উর্ধ্বে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি বই পড়তে পারবেন সে আশ্বাস দিচ্ছি।
প্রথম সংস্করণের বানানগত ত্রুটি সংশোধনের পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে যে তথ্যবিচ্যুতি ঘটেছে দ্বিতীয় সংস্করণে তা থেকে উত্তরণ ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। একটি ভাতৃসঙ্ঘ কিভাবে শতবর্ষ ধরে তাদের কর্মকা-কে ধারাবাহিকভাবে টিকিয়ে রেখেছে তা নিয়ে মূলত এই বইটিতে আলোচনা করা হয়েছে। সাধারণ একটি ট্রেড গিল্ড কিভাবে ধীরে ধীরে সভ্যসমাজের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে তার উপরেও একটি সাধারণ আলোচনা রয়েছে এখানে।
বিভিন্ন গোপনীয় বিষয়কে এখানে দেখা হয়েছে বিশ্বাসের মানদ- হিসেবে।
’Secrets as symbols of trust’ এই ধারণার উপর বিশ্বাস রেখে কাজকর্ম এগিয়ে নিতে গিয়ে নানা ধরণের সমস্যায় পড়েছে সংগঠনটি। পাশাপাশি তাদের কর্মকা-ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পৃথিবীর অনেক মানুষ। তবে কন্সপিরেসি থিওরি নিয়ে যারা কথা বলার চেষ্টা করে তাদের অনেকে পৃথিবীর সব ঘটন-অঘটনের সঙ্গে মুখস্ত যুক্ত করে ফেলে ফ্রিম্যাসনদের। চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গেলে এই বিষয়টির অসারতা এবং অতিরঞ্জন স্পষ্ট হয়।
সম্প্রতি বিভিন্ন ইউটিউব ভিডিওতে ফ্রিম্যাসনদের নিয়ে যা ইচ্ছা তাই বলে অনেকে জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করছেন। অনেক ওয়াজে দেখা যায় বক্তারা চোখ-কান বন্ধ করে মুখ আর কণ্ঠনালীর সর্বশক্তি দিয়ে ফ্রিম্যাসনদের পরিচয় করে দিচ্ছেন দাজ্জাল হিসেবে। অন্যদিকে অনেকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসেন একজন মুসলিম কি ফ্রিম্যাসনারি সদস্য হতে পারবেন। একই প্রশ্ন অনেক হিন্দু কিংবা বৌদ্ধের। তারাও অবাক বিস্ময়ে জানার চেষ্টা করেন হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ কেউ কি ফ্রিম্যাসন হিসেবে যুক্ত হতে পারবেন। এই বিষয়গুলো নিয়ে অনেক জটিল প্রশ্নের জন্ম নেয়।
তবে সেগুলোর সহজ সমাধান হিসেবে ফ্রিম্যাসনরা উত্তর দিয়ে থাকেন মূলত ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্র্মকে সামনে রেখে। তারা প্রত্যেকটি বিশ্বাসকে সম্মান দেখাতে পরামর্শ দিলেও ক্ষেত্রবিশেষে মূলত ক্যাথলিক মতবাদও ইহুদিবাদ গুরুত্ব পায়। একটি পর্যায়ে গিয়ে দেখা যায় ফ্রিম্যাসনদের কাছে যেকেনো ধর্মের তুলনায় তাদের লজকেন্দ্রিক গুপ্তসাধনাই মূখ্য। এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রথম সংস্করণে তেমন বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। দ্বিতীয় সংস্করণে বিষয়গুলোকে স্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বিশেষ করে ফ্রিম্যাসনারি সদস্যপদ অধ্যায়ে এগুলো তুলে ধরা হবে।
অনেকে জায়নবাদ, জেরুজালেম এবং ইসরাইলের নাম আসলে তার সঙ্গে ফ্রিম্যাসনদের নামটাও মুখস্থ বলে দিতে চান। এই বিষয়টির পেছনের যুক্তি কিংবা অন্তঃসারশূণ্যতার পাশাপাশি ফ্রিম্যাসনদের ইসলামোফোবিয়া নিয়েও বর্তমান সংস্করণে আলোচনা করা হয়েছে। অন্যদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের গুণী ব্যক্তিরা কেনো ফ্রিম্যাসনদের শত্রুজ্ঞান করেছেন তার প্রতিও আলোকপাত করা হয়েছে এই গ্রন্থে। বিশ্বের নানা স্থানের পাশাপাশি বাংলায় ফ্রিম্যাসনদের উপস্থিতি কেমন ছিল তা নিয়ে পূর্বের সংস্করণে তেমন বিস্তারিত বলা হয়নি। বর্তমান সংস্করণে সেই বিষয়গুলোকে যুক্ত করা হয়েছে।
গুপ্তগোষ্ঠী ফ্রিম্যাসনারির সদস্যরা মূলত তিনটি ডিগ্রি তথা স্তরে বিভক্ত। তাদের মধ্যে শিক্ষানবিশ এবং ফেলোক্রাফট ম্যাসনদের যথাক্রমে এক ও দুই ডিগ্রির ম্যাসন বলা হয়। এদের মধ্যে যে সম্পর্ক তাকে ব্রেদরেন তথা ভাতৃত্ব হিসেবে দেখা হয়। তাদের অনেক গুপ্ত প্রতীক ও চিহ্নের মধ্যে একটি হচ্ছে কর্নি বা টাওয়েল। রাজমিস্ত্রিরা মূলত এই কর্নির সাহাজ্যে বালু ও সিমেন্টের মিশ্রণ নিয়ে দেয়াল গাঁথুনির কাজ করেন। মাস্টার ম্যাসনের প্রতীক এই কর্নি। অন্যদিকে ফ্রিম্যাসনরা বিশ্বাস করে মাস্টার ম্যাসনের অধস্তন ফেলোক্রাফট এবং শিক্ষানবীশ ম্যাসনরা এক একজন বিশেষ দালানের ইটের মতো। একজন রাজমিস্ত্রি যেভাবে ইট দিয়ে ভবনে গাঁথুনি দেয়ার কাজ করেন, তেমনি একজন ফ্রিম্যাসন মাস্টার তার বোধ, বোধি ও যোগ্যতার উপযুক্ত প্রমাণ রেখে দিনের পর দিন শ্রম দিয়ে তৈরি করেছেন ফ্রিম্যাসন ব্রেদরেন তথা ভাতৃত্ব। এই ভাতৃত্ব এতোটাই শক্তিশালী যা অনেকক্ষেত্রে কল্পকথাকেও অতিক্রম করে যায়। এই গ্রন্থটিতে গুপ্তগোষ্ঠী ফ্রিম্যাসনারির বিভিন্ন ডিগ্রির অধীনে সক্রিয় সদস্য তথা ম্যাসনদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিস্তর আলোচনা রয়েছে।
বিভিন্ন বিষয় সংস্কারের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ছবি ও মানচিত্রের সংযোজন গ্রন্থটির কলেবর বৃদ্ধি করেছে। প্রয়োজন ও গুরুত্ব বিবেচনায় এবারের সংস্করণে একটি পুরো অধ্যায়ও যুক্ত হয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখা উচিত মনে করছি যে, আমার লেখা গুপ্তগোষ্ঠী সিরিজের সাতটি গ্রন্থের মধ্যে প্রথম এই ফ্রিম্যাসনারি। এখানে বর্ণনার প্রয়োজনে অন্য সব গুপ্তগোষ্ঠীর নাম ও তুলনা এসে যেতে পারে। পরবর্তী খণ্ডগুলোর যাঁরা পাঠক তাদের বিষয়গুলোতে সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য অনুরোধ করছি। বর্তমান সংস্করণ আগ্রহী পাঠকের চাহিদা পূরণ করতে পারলে দীর্ঘ পরিশ্রম সার্থক হবে বলে মনে করি।