প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ কিংবা গবেষণার বিষয় হিসেবে যারা প্রত্নতত্ত্ব কিংবা নৃবিজ্ঞানের মতো বিষয় বেছে নিয়েছেন, তাদের কাছে স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজার কিংবদন্তি এক নাম। এ নাম তারা জেনেছেন, পড়েছেন কিংবা পাঠের এক পর্যায়ে বুঝতে পেরেছেন যে, যুগান্তকারী সৃষ্টিশীলতার জন্য তার সহজ পরিচয় ‘গোল্ডেন বাউ’। মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত নানা বিশ্বাস ও সংস্কার কীভাবে সেই আদিকাল থেকে তার জীবনকে একটি বিশেষ দিকে চালিত করে, তার ইতিবৃত্ত এ বই। আদিম মানুষ বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির অশুভ প্রভাব মোকাবেলা, শস্য ও পশুপালনের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধিতে নানা অতিমানবীয় বিশ্বাস ও পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছে। এ পদ্ধতিগুলো কাজের ক্ষেত্রে কতটা সফলতার মুখ দেখেছে, সেটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে তা এক অর্থে মানুষের আত্মপ্রত্যয়ী অবস্থানকে আরো সুদৃঢ় করেছে— এটা কমবেশি স্বীকার করেছেন প্রায় প্রত্যেক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক ও নৃবিজ্ঞানী। সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলোকে উপযুক্ত ব্যাখ্যার পাশাপাশি নথিভুক্তকরণের যে গুরুদায়িত্ব, সেটাই পালন করেছেন জেমস ফ্রেজার; হয়েছেন ইতিহাসে অমর।
১৮৯০ সালের দিকে প্রথমবারের মতো দুই খণ্ডে প্রকাশ হয়েছিল গোল্ডেন বাউ। বিশ্বের নানা স্থানে নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বিবিধ আচারানুষ্ঠান ও বিশ্বাসের ইতিকথা এভাবে দুই মলাটে গুছিয়ে লেখার সাহস এর আগে কেউ দেখায়নি। ফলে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সাড়া পেয়েছিলেন ফ্রেজার। এতে উৎসাহী হয়ে এর প্রায় বছর পঁচিশেক পার করে ১৯১৫ সালের দিকে তিনি প্রায় ১২ খণ্ডে প্রকাশ করেছিলেন বইটির বর্ধিত সংস্করণ। গবেষক থেকে শুরু করে সাধারণ পাঠক প্রত্যেকের কাছেই গোল্ডেন বাউ ছিল এক অপার বিস্ময়। তাই শুরুতে বইটি কেবল প্রশংসার বাণী শুনে ক্লান্ত হয়। বন্য-বর্বর-সভ্য অভিধায় মানবসংস্কৃতির সামাজিক বিবর্তনে যে একরৈখিক ধারণা হেনরি লুই মর্গান দিয়ে গেছেন, তা অনেক দিক থেকে প্রমাণ করে দিয়েছিল এ বই। ফলে ঔপনিবেশিক নানা দেশ এর প্রচার, প্রসার ও বিপণনের দায়িত্ব অনেকটাই লুফে নিয়েছিল। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে উত্তরোত্তর সাফল্য দেখতে পান ফ্রেজার। একটা পর্যায়ে ফ্রেজার যখন দেখাতে চাইলেন মানুষের ইতিহাস ও চিন্তার পর্যায় তিনটি— জাদু, ধর্ম এবং বিজ্ঞান, সেখানেই তার জনপ্রিয়তা হয়ে ওঠে আকাশচুম্বী।
বিশ্বের অনেক ভাষায় অনূদিত হলেও মাতৃভাষা বাংলায় বিশাল কলেবরের এ বই কোনোদিন দেখতে পাওয়ার আশা করিনি। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন শ্রদ্ধাভাজন খালিকুজ্জামান ইলিয়াস স্যার। আগ্রহী হয়ে উঠি এবং বইটি বাজারে আসার প্রথম দিনেই সংগ্রহ করি পেপারব্যাক সংস্করণটি। সহজ, প্রাঞ্জল অনুবাদের পাশাপাশি উপযুক্ত তথ্যসূত্রের সন্নিবেশে জেমস জর্জ ফ্রেজার বোধ হয় নতুন করে ভাষা খুঁজে ফিরেছেন বাংলাদেশের অপার সৃষ্টিশীল এক লেখকের কলমে। গোল্ডেন বাউ গ্রন্থটির অনুবাদ প্রকাশের সময় মলাটেই লেখা হয়েছে— ‘মানুষের জাদুবিশ্বাস ও ধর্মাচার বৃত্তান্ত’। এ কথাগুলোর মধ্য দিয়ে অনুবাদক সরাসরি পাঠকের কাছে প্রকাশ করতে চেয়েছেন, বইটি পাঠ করলে পাঠক কোন বিষয়ে জানতে পারবেন। বিশেষত অতীত আচারানুষ্ঠান, কৃত্য, যাগ-যজ্ঞ কিংবা বিশ্বাসের পাঠ নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের জন্য প্রথম পছন্দ হয়ে উঠতে পারে এ বই।
বিশালাকৃতির এ বই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে ফেলা গেছে অনেকটা ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। স্মৃতিচারণ করলে বলাই যায়, রাতভর পড়ার টেবিলে বসে, তারপর নির্ঘুম রাত শেষে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের জন্য মিরপুরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কিংবা বাসে, এমনকি ক্যাম্পাসে গিয়ে নানা ঝক্কি-ঝামেলার কাজ থেকে বের করা ক্ষুদ্র অবসরে পড়ার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র বিরক্তি জাগায়নি এ অনুবাদ। বাইবেল আক্ষরিক অনুবাদের যে বিশেষ ধারা থেকে বিশ্বের নানা দেশের অনুবাদক বের হয়ে বিন্দুমাত্র প্রগতিশীলতা দেখাতে পেরেছেন, তারা কলমের স্বাধীনতার সমানুপাতে জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছেন। এ বইটি তার উপযুক্ত প্রমাণ। অন্তত আক্ষরিক অনুবাদের একঘেয়ে কাজ হলে গোল্ডেন বাউয়ের এত বিশাল কলেবর দেখে বেশির ভাগ পাঠক বইটি পড়া দূরে থাক, পাতা উল্টে সময় নষ্ট করার সাহসটুকুও দেখাতেন না।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ‘গোল্ডেন বাউ’ প্রকাশ একদিক থেকে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলার মতো কাজ। তবে আক্ষরিক বা বাইবেল অনুবাদের মতো অনুবাদে বিশ্বাসী যারা, তারা এই বই মহা আনন্দেই লাইন টু লাইন মূল বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে বিশিষ্ট অনুবাদক গ্রেগরি রাবাসা বর্ণিত ‘হরেন্ডু’ (যারা উকুন খোঁজার মতো অনুবাদের লাইন ধরে ধরে মূল বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে ভুল অনুবাদ প্রমাণের চেষ্টা করেন) হওয়ার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। এ শ্রেণীর জন্য গোল্ডেন বাউ অনুবাদ অনেকটা অসম্ভব চিন্তা লালন করার মতো।
অনুবাদকের জন্য একজন ওরিয়েন্টালিস্ট জেমস ফ্রেজারের সূক্ষ্ম চিন্তার নানা দিক, যুক্তিবাদী মন ও মননের অভিক্ষেপ আরেকটি ভাষায় প্রকাশের কাজটা তেমন সহজ ছিল না। তিনি জীবনমৃত্যুর পরিক্রমা নিয়ে শুভ-অশুভের বর্ণনার ঘেরাটোপে কোথায় ঔপনিবেশিকতার জাল বিস্তার করতে চাইছেন, সেটা আত্মস্থ করাই বেশ কঠিন। তারপর অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তা বুঝে আরেকটি ভাষায় একই সঙ্গে ছুরি-কাঁচি আর কলম চালানো প্রায় অসম্ভবের নামান্তর মাত্র। মূল বই পাঠ করতে গিয়ে বারবার যে সমস্যায় পড়েছি, তা হচ্ছে বাক্যের দীর্ঘতা। সহজ অর্থে বলতে গেলে এক দমে পড়ে শেষ করার মতো বাক্য খুব একটা লেখার আগ্রহ ফ্রেজার দেখাননি। প্রায় প্রতিটি পাতায় একটি প্যারার শুরুতে হয়তো কোনো বাক্যের শুরুটা খুঁজে নেয়া যায় অল্প আয়েশে, তবে তার প্রান্তভাগ খুঁজতে খুঁজতে খেই হারিয়ে ফেলতে হয়। তাই একজন অনুবাদক যখন অনুবাদ করেন, সেখানে প্রথম চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে এর বোধগম্যতা নিশ্চিত করায়। এক্ষেত্রে পরপর অনেক বাক্যে ভেঙে ফেললে ফ্রেজারের বর্ণনার মূল সুর থেকে বিচ্যুতি ঘটার শঙ্কাও থেকে যায় বেশ। সেদিক থেকে চিন্তা করে অনুবাদক চেষ্টা করেছেন একটা উইন উইন সিচুয়েশন বজায় রাখতে। বলতে গেলে তিনি বোধগম্যতার ক্ষেত্রেও যেমন সচেতন ছিলেন, তেমনি বাক্যকে ছোট কিংবা কাটছাঁট করার ক্ষেত্রে বৈষয়িক চ্যুতি প্রতিরোধে সতর্ক দৃষ্টি ছিল তার।
ইতিহাস প্রত্নতত্ত্ব কিংবা নৃবিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থী, গবেষক কিংবা শিক্ষকের দৃষ্টিতে দেখতে গেলে গোল্ডেন বাউ মোটেও কোনো গবেষণা গ্রন্থ নয়। এর চেয়ে একে ঢের গবেষণানির্ভর সাহিত্য বলে চালিয়ে দেয়া যায়। এটাকে যদি ‘নৃতাত্ত্বিক সাহিত্য’ পদবন্ধে বেঁধে ফেলে বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়, সেটাই বোধ করি যুক্তিযুক্ত হবে। তবে অনুবাদের ক্ষেত্রে মূল সংকট অন্যখানে। বিশেষত লেখক কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের নানা কৃত্য বোঝাতে তাদের গান, কল্পকথা, গল্পগাথা কিংবা ছোটখাটো ছড়াগুলোর কথাও উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়গুলো কোন বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে রচিত হয়েছিল, সেটা খেয়াল না করেই ফ্রেজার নিজের মতো করে বর্ণনা দিয়ে এক ধরনের বিচ্যুতি ঘটিয়েছেন। এরপর তাকে অনুবাদক যদি নিজের খেয়ালখুশি সামনে রেখে আরেক ভাষায় লেখার চেষ্টা করেন, আদতে তা বাস্তবতা থেকে যোজন যোজন দূরে সরে যেতে বাধ্য। বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর ব্যবহূত নানা শব্দ ফ্রেজার যেভাবে ব্যবহার করেছেন, সেটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। এরপর অনুবাদক যখন তার নিজের ভাষায় লেখার চেষ্টা করবেন, সেখানে সংকট কমে না; বরং ঘনীভূত হয়। অন্যদিকে গোল্ডেন বাউ তার ঐতিহাসিকতায় যেসব আচারানুষ্ঠানের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন, তার সিংহভাগ হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। এখনকার দিনে ডাকিনীবিদ্যা, ভূতচর্চা কিংবা পিশাচ সাধনা বলতে যা বোঝায়, সেটার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে গোল্ডেন বাউয়ের মূল বক্তব্য থেকে সরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বহুগুণে।
অদ্ভুত কিছু শব্দ পাঠককে মোহিত করে রাখতে পারে। বিশেষ করে অনেক পাতা পড়তে গেলে পাঠক চমকেও উঠতে পারেন, আত্মার নির্বাসন ও পুনর্জাগরণ, ছায়ারূপী ও বিম্বরূপী আত্মা, বৃষ্টি-সূর্য-হাওয়ার কুহকী, অবতার, কুফাগ্রস্ত বস্তু ও মানুষ কিংবা ডাইওনিসাস-ছাগল-বলদ প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার আগ্রহী করে তুলবে যেকোনো পাঠককে। তবে বহ্ন্যুৎসব, ত্রিশঙ্কু, পাঁঠা বলি, অসূর্যস্পশ্যা, ঋতুরম্ভ, অগ্ন্যুৎসব প্রভৃতি ভারিক্কী ধাঁচের শব্দের ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় বলেও মনে হতে পারে। বিশেষ করে মূল ইংরেজি থেকে অনুবাদ করার ক্ষেত্রে এ ধরনের কঠিন তৎসম, তদ্ভব কিংবা অর্ধতৎসম শব্দের ব্যবহার আর যা-ই হোক, সাধারণ পাঠককে অপেক্ষাকৃত কম সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডারজনিত সংকটে ফেলতে পারে। তার পরও অগণিত ছবি ও স্কেচ ব্যবহার পুরো গ্রন্থটিকে করে তুলেছে সহজ সাবলীল ও প্রাঞ্জল। বেশির ভাগ ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা হলেও দু-একটা বাদ দিলে প্রায় প্রতিটি ছবিই পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক। বলতে গেলে ঝরঝরে অনুবাদকে আরেকটু প্রাঞ্জল ও গতিশীল করে তুলেছে সংশ্লিষ্ট এ ছবিগুলোর স্থান অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যবহার।
অনুবাদসম্রাট গ্রেগরি রাবাসা যখন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ভুবনবিখ্যাত গ্রন্থটির অনুবাদ করতে গিয়ে ঠিক শুরুতেই তার নিজের মতো করে লিখেছিলেন, ‘Many years later, as he faced the firing squad, Colonel Aureliano Buendía was to remember that distant afternoon when his father took him to discover ice.’— বিস্মৃত মার্কেস বলেই বসেন, এ অনুবাদ মানের দিক থেকে মূল সাহিত্যকর্মকে ছাপিয়ে গেছে। একজন পাঠক হিসেবে আমার অনুভূতি অনেকটা তেমন। এ অনুবাদের মধ্য দিয়ে জেমস জর্জ ফ্রেজার আবার বহু বছর পর নবজীবন লাভ করেছেন। তার গোল্ডেন বাউ একটা সোনালি অনুভূতির জন্ম দিতে পারল এ দীর্ঘ অনুবাদকর্মের মধ্য দিয়ে।