ডোনাল্ড ট্রাম্প শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন বেটসি ডেভোসকে। তিনি শিক্ষার বেসিক টার্মগুলোও জানেন না, পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় শিক্ষা ব্যবস্থার বিধিমালায়ও তার তেমন দখল নেই বলা চলে, তবে তিনি কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো ঠিকই স্কুল কর্মকর্তাদের বন্দুক বহনের অনুমতি দেয়ার কথা ভাবছেন। ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন মনিকা ক্রাউলি, তবে তার অতীত লেখালেখি আর কর্মকাণ্ডে ঘাপলা ধরা পড়ায় পদ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে তাকে। এদিকে জাতীয় পর্যায়ের অনেক পদ এখনো শূন্য। পুরোটাই অস্পষ্ট থেকে গেছে নতুন প্রশাসন কীভাবে চলবে তার গাঠনিক বিন্যাস কেমন হবে।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন অনেকটা আকস্মিকভাবে ঘোষণা দিয়ে বসেছেন দক্ষিণ চীন সাগর দিয়ে চীনের প্রবেশ একেবারে রুদ্ধ করে দেয়া হবে। তবে তিনি যে এর মাধ্যমে সরাসরি চীনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন, সেটা তার চিন্তাতেও ছিল না। এক্ষেত্রে একটি বিষয় কি খেয়াল করা যায়? আসলে নতুন প্রশাসনে যারা আসছেন, তাদের প্রত্যেকেই হয়তো দুর্নীতিগ্রস্ত হতে পারেন। তবে দীর্ঘদিনের অনুশীলনে তারা দুর্নীতিকে একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। তাই তো অনেক ট্রাম্পভক্ত মনে করছেন, তারা একজন যোগ্য ব্যবসায়ীকে তাদের নেতা হিসেবে নির্বাচন করেছেন, যে তাদের জন্য সুন্দর গোছালো একটি দেশ উপহার দিতে পারবেন। অন্তত তাদের বিশ্বাস, ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পর যা-ই হোক, তাদের চাকরি নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।
মানুষ যা চিন্তা করেছিল, তা এখনই হচ্ছে না। কিন্তু ট্রাম্পের এতটা তাড়া নেই যে, তিনি হুটহাট সব বদলে দেবেন। তিনি এখনো অনেক ক্ষেত্রে অনিরাপদ বোধ করছেন, পাশাপাশি একজন ইগোম্যানিয়াক হিসেবে আগের অবস্থান থেকে কোনো ধরনের ছাড় দিতেও প্রস্তুত নন তিনি। সবচেয়ে বিশ্রী ব্যাপার হচ্ছে, তিনি বিশাল একটি তোষামোদকারী শ্রেণীকে নিয়ে থাকেন, যারা তার দোষত্রুটিগুলো কখনই দেখিয়ে দেয় না। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি তাদের সঙ্গেই কাজ করে খুশি হন।
এদিকে দেশের অর্থনীতি থেকে শুরু করে কূটনীতি সব ক্ষেত্রেই একটু বদলে দিতে চাইছেন ট্রাম্প। তার ইচ্ছা, জাতীয় নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে পুরো প্রশাসনকে নিজের মতো করে ঢেলে সাজাবেন। এক্ষেত্রে কে কোন অবস্থানে ছিলেন, কী ধরনের কাজ করেছেন, পাশাপাশি অবস্থানগত গুরুত্বের ধার না ধেরে চলছে ঢালাও রদবদল। এদিকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে মাইকেল ফ্লিনকে, যিনিও আগে থেকেই ইন্টারনেট কন্সপিরেসি থিওরিতে আসক্ত। এক্ষেত্রে এমন একটি দলকে কাজে নামানো হচ্ছে, যারা দলনেতার ভুলত্রুটিগুলো শুধরে নেবে না, বরং তাদের হাত ধরে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির ভুল আরো গভীর থেকে গভীরতর হবে।
এসব সিদ্ধান্তের ভবিষ্যত্ আসলে কী? এক্ষেত্রে ট্রাম্প-পুতিন সম্পর্কই বা কেমন হবে, এর সঙ্গে কি বুশ-চেনি সম্পর্ককে মেলানো যাবে? এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠছে দেদার। এক্ষেত্রে রিপাবলিকান প্রশাসন থেকে কী ধরনের পরিবর্তন আসছে, তা নিয়ে উন্মুখ হয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রবাসীর পাশাপাশি পুরো বিশ্ব। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে ধরা হচ্ছে অযোগ্য ব্যক্তিদের অনেক বড় আর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়োগ প্রদান। আর এখান থেকেই সবচেয়ে বড় ধস নামবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইরাক যুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যেমন আগের সময়টায় যুক্তরাষ্ট্রে তেমন ভূমিকা রাখেনি, এবারেও ট্রাম্প সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অন্য কারো মতের তোয়াক্কা করবেন না। তিনি দলগত মোসাহেবদের পাশাপাশি করপোরেট মুনাফাখোরদের সব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়োগ দিয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছে যোগাযোগের দিক থেকে বেশ পিছিয়ে থাকা বেটসি ডেভোসের ভাই এরিক প্রিন্স। ইরাক যুদ্ধ চলাকালে মার্সেনারি আউটফিট ব্ল্যাকওয়াটার তৈরির মধ্য দিয়ে জনাকীর্ণ অঞ্চলে গোলাগুলির মাধ্যমে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। বলতে গেলে তখনকার ইরাকে যে বিশৃঙ্খলা, তা এখনো কাটেনি। আর সেখানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ কবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে, তা নিয়ে নিশ্চিত করে বলতে পারে না কেউই। বুশ সময়কালে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নানা পদে স্বজনপ্রীতি ঘিরে ধরেছিল, তা আবার নতুন করে ফিরে আসতে পারে এবারে প্রশাসনিক রদবদলের মধ্য দিয়ে। আর এর থেকে সৃষ্ট সংকট কীভাবে উত্তরণ করা যাবে, তা নিয়ে বলতে নারাজ সবাই।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের নেতৃস্থানে থেকে কী করবেন, সেটি এক অর্থে তার ব্যক্তিগত। তবে এর ফল ভোগ করতে হবে পুরো দেশবাসীকে, যার থেকে মুক্ত নন বিশ্ববাসীও। এক্ষেত্রে কংগ্রেসে বিরোধী দলের ভূমিকা কেমন হবে, তা নিয়েও এখন নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে চীনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন, তা নিয়ে কিছু না বললেও চলে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা খাতে একটি বড় রকমের ধস লক্ষ করা যাবে আগামী দিনগুলোয়— এমনটাই অনুমান করছেন সবাই।
আর্থিক খাতেও বড় রকমের পরিবর্তন আশা করছেন সবাই। এক্ষেত্রে অনেক রদবদল ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বেশ বিপজ্জনক হয়ে দেখা দিতে পারে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বাল্টিক অঞ্চলের রাজনীতিতেও যুুক্তরাষ্ট্র এবার একটা বড় বদল আনতে পারে, যা ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য মঙ্গলজনক হবে বলে ভাবছেন কেউ কেউ। তবে সেখানে এমন কোনো চমক অপেক্ষা করছে কিনা, আগে থেকে সে প্রসঙ্গে তেমন ধারণা নেই বলা যেতে পারে। প্রকৃত সমস্যা থেকে উত্তরণে চাই উপযুক্ত সমাধান। এক্ষেত্রে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী টুইট করা কিংবা এফবিআইয়ে বন্ধু রাখা কিংবা ক্রেমলিনের সহায়তায় ভালো মিডিয়া কাভারেজপ্রাপ্তি সব কথার শেষ কথা নয়। এক্ষেত্রে সবার আগে যোগ্য, দক্ষ ও উপযুক্ত ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় স্থানে নিয়োগ দেয়াটা সবচেয়ে জরুরি।
সম্প্রতি নানা পদের রদবদল নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। তবে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে যার নাম উঠেছে, তার ডাকনাম হিসেবে প্রচলিত আছে ‘পাগলা কুত্তা’ শব্দবন্ধটি। ফলে যে প্রশাসনিক কাঠামো যুক্তরাষ্ট্র আগামীতে পেতে যাচ্ছে, এটি শুধু দুর্নীতিগ্রস্তই হবে না, এদের অনেকে সরকার চালানোর ন্যূনতম যোগ্যতাও ধারণ করেন না। এটি সত্যিই এক বিশ্রী অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে, হয়তো তা নিয়ে পরে আরো বলার সুযোগ হবে।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যানের নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত লেখা থেকে অনূদিত।