মঙ্গলবারের নির্বাচনে লাখ লাখ আমেরিকান তাদের রায় দিয়ে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর নিজেদের অনাস্থা স্পষ্ট করেছেন, যারা তাদের চেয়ে ধনিক ও করপোরেটদের স্বার্থ বড় করে দেখেছেন। আমি হিলারি ক্লিনটনকে সমর্থন দিয়েছিলাম, তার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণাও চালিয়েছি। বিশ্বাস করতাম, তিনি খুব সম্ভবত এবারের নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী হবেন। কিন্তু ডোনাল্ড জে. ট্রাম্প এখন হোয়াইট হাউজে পা রাখতে যাচ্ছেন, যেখানে তার অবস্থান বেশ স্পষ্ট ছিল। তিনি বাস্তব ক্ষোভকে কাজে লাগাতে পেরেছেন, যেটা ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন ট্র্যাডিশনাল ডেমোক্র্যাটরা।
এ বিজয়ে মনঃক্ষুণ্ন হলেও হতবাক হইনি। আমি এটা নিয়ে কোনো কষ্টও পাইনি যে কয়েক মিলিয়ন মানুষ, যারা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন, তারা একটি অর্থ ব্যবস্থা, রাজনৈতিক অবস্থান ও গণমাধ্যমের প্রচারণা দেখতে দেখতে ক্লান্ত ছিলেন। কর্মজীবী পরিবারগুলো দীর্ঘদিন থেকে দেখছে, রাজনীতিকরা কীভাবে বিলিয়নেয়ারদের থেকে অর্থসহায়তা নিয়ে তাদের ক্যাম্পেইন করেছেন। শেষ পর্যন্ত করপোরেট ইন্টারেস্ট তাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে। ক্ষমতায় গিয়ে রাজনীতিকরা সাধারণ আমেরিকানদের অধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। গত তিন দশকে এটাই হয়েছে, যেখানে অনেক আমেরিকান তাদের করপোরেট বসদের কাছে মাথা বিক্রি করে বসে আছেন। শ্রমিকরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে নামমাত্র বেতন তুলেছেন। পাশাপাশি তারা এও দেখেছেন, তাদের চোখের সামনে চীন, মেক্সিকোসহ কম বেতনের দেশগুলোর মানুষ অপেক্ষাকৃত বেশি বেতন উত্তোলন করছে। তারা এখন ত্যক্ত-বিরক্ত এটা দেখে যে, প্রধান নির্বাহীরা কাজের চেয়ে প্রায় ৩০০ গুণ বেতন নিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে তাদের মোট আয়ের প্রায় ৫২ শতাংশ চলে যাচ্ছে একেবারে উপরের স্তরের ১ শতাংশ কর্মকর্তার পকেটে। এতে তাদের অনেক শহরতলী এখন জনশূন্য হওয়ার পথে, ডাউন টাউনের অনেক দোকানপাটের দরজা এখন আর খোলে না। তাদের বাচ্চারা এখন বাড়িঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কারণ কোনো কাজ নেই। করপোরেশনগুলো তাদের ধীরে ধীরে একটি বিশেষ কমিউনিটির ভৃত্যে পরিণত করেছে। ফলে তারা নতুন কিছু ভাবতে বাধ্য হয়েছে।
কর্মজীবী আমেরিকানরা সন্তানদের উপযুক্ত যত্ন-আত্তির ব্যবস্থা করতে পারছে না। তারা ছেলেমেয়েদের কলেজে পাঠাতে পারছে না। অবসরে যাওয়ার পর ব্যাংকে তাদের তেমন গচ্ছিত অর্থসম্পদ নেই। দেশের নানা স্থানে বসবাসের জন্য চলনসই কোনো বাড়ি তারা বানাতে পারছে না। হেলথ কেয়ার ও ইন্স্যুরেন্সের জন্যও তাদের থেকে কেটে নেয়া হচ্ছে মোটা অংকের অর্থ। হতাশাগ্রস্ত অনেক পরিবারকে এখন বাধ্য হয়ে ড্রাগ, অ্যালকোহলে ডুবে থাকতে হচ্ছে কিংবা বেছে নিতে হচ্ছে আত্মহননের পথ।
আমেরিকার মানুষ একটি পরিবর্তন চেয়েছিল, সেদিক থেকে ধরলে ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়াকে সঠিক বলা যায়। কিন্তু তারা নিজেদের জন্য কী পরিবর্তন নিয়ে এল, সেটা এখন আলোচ্য বিষয়। তারা কি এখন আমেরিকার বড় ধনিক পরিবার ও সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে? তারা কি নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, নাকি আরো নুইয়ে পড়বে চলমান অর্থ ব্যবস্থার কাছে? নিজেদের যে রকম আর্থিক দুরবস্থার সম্মুখীন মনে করে নেটিভ আমেরিকানরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা কি খড়্গহস্ত হয়ে দেখা দেবে দুর্বল অভিবাসী, অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য?
যা-ই হোক, নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট কি তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারবেন, যারা ওয়াল স্ট্রিট কারসাজির জন্য দায়ী? বিশেষ করে বড় বড় ব্যাংক যেভাবে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে গিলে খেয়েছে, তার থেকে উত্তরণের পথ করে দিতে তিনি কি সচেষ্ট থাকবেন? তিনি কি গ্রামীণ আমেরিকা ও ইনার সিটিগুলোয় নতুন করে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করবেন? নাকি তিনিও আরেকজন ওয়াল স্ট্রিট ব্যাংকারকে নিয়োগ দিয়ে খাজাঞ্চিখানার ব্যবসাকে আরো প্রসারে সহায়তা জোগাবেন? নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি যেভাবে স্থানীয় ওষুধের বাজারে নিয়ন্ত্রণারোপের পাশাপাশি প্রেসক্রিপশনের উল্লিখিত ওষুধের দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা কতটুকু বাস্তবে রূপ নেয়— সেটা এখন দেখার বিষয়।
আমি অনেক চিন্তিত ওই পরিবারগুলোকে নিয়ে, যারা ট্রাম্পের বিজয়ের পর ভীতির মধ্যে রয়েছে। একটি দেশ, যারা অসমতা দূরীকরণের জন্য লড়াই করছে, সেদিক থেকে আমাদের অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। আমাদের পক্ষে যা-ই হোক অন্তত পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। আমরা বর্ণবাদ, ধর্মান্ধতা, বহিরাগতদের আগমনভীতি ও যৌনতা নিয়ে অজ্ঞদের মতো আচরণ করতে পারি না। আমাদের এগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে হবে।
আমি দেখতে চাই ট্রাম্প কি পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলেন আর আগামীতে সেগুলো কীভাবে কাজ করে। তিনি নির্বাচনে বিজয়ের পর কীভাবে উন্নয়নকে নেন, সেটাই বিবেচ্য। তিনি যদি নির্বাচনে জয়লাভের পর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কর্মজীবী পরিবারের অবস্থা উন্নয়নের চেষ্টা করেন, তাহলে আমি তাকে সমর্থন দেব। এর পর তিনি উদ্যোগ নিতে পারেন আমাদের ভঙ্গুর অবকাঠামো উন্নয়নে, যেখানে অনেক উন্নত চাকরির সুযোগ সৃষ্টি সম্ভব। অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে পুরো ব্যবস্থাকে জনবান্ধব করে তোলার চেষ্টা চালানো হোক। একজন বিলিয়নেয়ার হিসেবে ট্রাম্প চাইলেই পারেন ধনী নির্বাচন ক্যাম্পেইনারদের প্রভাবমুক্ত করে দেশ চালাতে, যারা আর নির্বাচনকে কিনতে পারবে না।
আসন্ন দিনগুলোয় ডেমোক্রেটিক পার্টিতে অনেক সংস্কার আশা করছি। এজন্য তৃণমূল থেকে শুরু করে সব মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিতকরণ এখন সময়ের দাবি। আদর্শবাদী চিন্তা সামনে রেখে যারা কাজ করতে চান, তাদের জন্য পথ উন্মুক্ত রেখে আমরা নতুনদের সুযোগ দিতে চাই। এতে অর্থনৈতিক, সামাজিক, বর্ণ ও পরিবেশগত সুবিচার নিশ্চিতকরণ সম্ভব হবে। আমাদের এটুকু সাহস থাকতে হবে যাতে ওয়াল স্ট্রিটের পাশাপাশি ড্রাগ ইন্ডাস্ট্রি, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ও জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিমত্তার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারি।
নির্বাচনী ক্যাম্পেইন শেষ হতে না হতেই সমর্থকদের বলেছিলাম, রাজনৈতিক এ বিপ্লব অব্যাহত থাক। আর এখন আমি বিশ্বাস করি, সেটা হতেই হবে। আমরা বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী দেশ। আমরা সবাই মিলেমিশে থাকতে চাই। কথিত জননেতারা এ দেশকে জাতিসত্তা, বর্ণবাদ কিংবা জেন্ডারের ইস্যুতে খণ্ড-বিখণ্ড করুক, এটা মানতে পারছি না।
ভারমন্টের সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স যিনি ২০১৬ মার্কিন নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। নিউইয়র্ক টাইমস থেকে ভাষান্তরিত।