মাস চারেক আগে সিএনএনের বিশ্লেষণে প্যাট্রিক গিলেস্পি দাবি করেছিলেন, পাঁচটি কারণে ভেনিজুয়েলার অর্থনীতিতে শনির দশা আসন্ন। কিন্তু তার বিপরীতে মাদুরো সরকারের দমননীতি দেখে তখন যে কেউ মনে করতেন যে, তাদের বৃহস্পতি বেশ তুঙ্গে। গিলেস্পি দেখিয়েছিলেন, তেলের দরপতনে কেউ যদি পপাত ধরণীতল হয়, তাহলে তালিকার শীর্ষে থাকবে ভেনিজুয়েলার নাম। অর্থনীতি পুরোপুরিই নির্ভরশীল তেলের ওপর; তাই ২০১৩-১৪ সালের দিকে যখন ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ১০০ ডলারের উপরে, তখন তাদের পায় কে। কিন্তু বিধি বাম। প্রায় এক যুগের মধ্যে প্রথমবারের মতো হঠাৎ করে সেই দাম যখন ব্যারেলপ্রতি ২৮ দশমিক ৩৬ ডলারে গিয়ে নেমেছে, সবার আগে দেয়ালে পিঠটা ঠেকে গেছে তাদেরই। ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে, যখনই তেলের দাম পড়ে গেছে, ঠিক তখন নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে ভেনিজুয়েলাকে।
একটা সময়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে অনেকটা সমাজতান্ত্রিক জোশ নিয়ে উগো চাভেজের কাণ্ড দেখে বেশ মজা পেয়েছিল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। মানুষ হাততালি দিয়ে উঠেছে আস্তিন ছেঁড়া জামা পরা ইরানের রাষ্ট্রপতি আহমাদিনেজাদের সঙ্গে চাভেজের কোলাকুলি দেখে। কালের আবর্তে সাংস্কৃতিক বিবর্তন নিয়ে এ যেন হেনরিকা কুকলিকের সেই ‘দ্য শ্যাভেজ উইদিন’-এর উপস্থিত পদবাচ্য হুগো চাভেজ নয়। নাম মেলানো যায়, ঘটনা নয়। আলেহান্দ্রা অ্যারেজা একেই বলেছেন ‘বিগেস্ট লুজার ইন লাতিন আমেরিকা ফ্রম অয়েল প্রাইজ ক্রাশ’। যদি তা না হয়, তবে ২০১৬ সালে কীভাবে তাদের রফতানি ৭৫ বিলিয়ন থেকে ২৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
তেলের দরপতনের পর ভেনিজুয়েলার জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রা বলিভারের অবমূল্যায়ন। মাত্র এক বছর আগে যেখানে এক ডলারের মূল্যমান ছিল ১৭৫ বলিভার সমতুল্য। গত জানুয়ারিতে তা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৮৬৫ বলিভার সমমানে। সম্প্রতি ডলার টুডে ডটকম থেকে বেসরকারি পর্যায়ে এক বলিভারের বিনিময় গিয়ে দাঁড়িয়েছে এক পেনির সহস্রভাগের নিচে। এমন অবমূল্যায়ন ও আর্থিক বিপর্যয়কে থোড়াই জ্ঞান করে এগিয়ে যেতে থাকে ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি। মূল্যস্ফীতির অঙ্ক হিসাব না করে একের পর এক ছাপানো হয় কাগজি মুদ্রা। পাশাপাশি মাদুরোর সরকার এমন এক অদ্ভুতুড়ে নিয়ম তৈরি করেছে, যেখানে একই ডলারের তিনটি ভিন্ন এক্সচেঞ্জ রেট রয়েছে। এতে উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে না পড়ে সবাই চাইছে বেসরকারি পর্যায়ে যেভাবে হোক ডলার বদলে নিতে। ফলে রাজস্ব বলতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কানাকড়িও মিলছে না, দিনের পর দিন অর্থনীতি নিমজ্জিত হচ্ছে অতলান্তিকের অতলে। বাস্তবে ‘আউট অব ক্যাশ’ হওয়ার পর তাদের দেশ এখন চলছে সরাসরি রিজার্ভের স্বর্ণ বিক্রি করে।
সমুদ্রভর্তি লোনা পানি থাকার পরেও কোনো বিপন্ন জাহাজের নাবিক যেভাবে পানিকষ্টে ভোগেন, তেমনি তেলের সাগরে নিমজ্জিত হয়েও পাওয়ার প্লান্টের অভাবে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে অন্ধকার হয়ে আছে ভেনিজুয়েলা। মূল্যস্ফীতি, অর্থের অবমূল্যায়ন, আর্থিক সংকটের এমন কঠিন পদবাচ্যগুলো কি মেনে নেয়া যায়? তবে আমরা যারা গণমানুষের স্থান থেকে চিন্তা করি, কম জানি কম বুঝি, তাদের মনে একটা প্রশ্ন সবার আগে আসবে, সেটা হচ্ছে— বিদ্যুৎ খাতে কেন তাদের এ দুরবস্থা? কোন জাদুমন্ত্রবলে তাদের পুরো দেশ ডার্ক আউট হয়ে গেছে। শুধু বিদ্যুতের অভাবে সরকারি দফতর চলছে মাত্র দুদিন। আর এতগুলো প্রশ্নের একটাই জবাব, আর তা হচ্ছে— চাভেজ সরকারের আমলে সব বিষয় নিয়েই জবাবদিহিতার অভাব। তখন উন্নয়ন নামের ‘কাজীর গরু কেতাবে ছিল’, আদতে গোয়ালের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারেনি। ফলে শতকোটি ডলার ব্যয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়েছে ঠিকই, সেগুলো উৎপাদনে আসার আগেই নিভে গেছে আশার আলো। বাস্তবে এগুলোর নির্মাণ বাবদ যে অর্থ ব্যয় হওয়ার কথা, তা হয়নি; উপরন্তু সেগুলোই গিয়ে পকেট ভারী করেছে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের। সেখানে একদিকে সরকারি দলের লাগামহীন দুর্নীতি চলেছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় পেটোয়া বাহিনী দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে মুখ বন্ধ করে রেখেছে জনগণের। এর বদলে গণমাধ্যমে দেখানো হয়েছে উন্নয়ন মরীচিকা। আর সে মরীচিকার পেছনে দৌড়ে এখন শেষ নিঃশ্বাসের প্রহর গুনছে দেশটির হাজারো মানুষ।
সরকার শক্তিশালীকরণের পাশাপাশি উন্নয়নে গতি আনতে ভেনিজুয়েলা থেকে উঠিয়ে দেয়া হয় সব ধরনের জবাবদিহিতার বিধান। ফলে সরকার খেয়ালখুশিমতো নিত্যনতুন নিয়ম করে সেটা বাস্তবায়নের আগেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা রাষ্ট্রের অর্থ দুহাতে উড়িয়েছেন। পদলেহী বুদ্ধিজীবীদের কুপরামর্শে মিলিয়ন ডলার খরচে সেখানে বানানো হয়েছে মিথ্যাচারের চলচ্চিত্র। এক্ষেত্রে সৈনিকরা ক্ষমতার চূড়ায় অবস্থান করে বিলাসব্যসনে মাত্রা ছাড়িয়েছে বহু দিক থেকে। দেশের গৌরবকে সমুন্নত করার অজুহাতে মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছে কার রেসিংয়ের পেছনে। আর বলতে গেলে এসবের ফল হিসাবেই ভেঙে পড়েছে তাদের রাষ্ট্রযন্ত্র। অনর্থক সরকারীকরণ বলতে গেলে তাদের উদ্যোক্তা বিকাশ ও বেসরকারি বিনিয়োগের পথ রুদ্ধ করে ভেঙে দিয়েছে অর্থনীতির মেরুদণ্ড। সাময়িক মুনাফা আর বাকোয়াস জিডিপির ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বাড়ানো পরিসংখ্যান আরো উত্সাহ জুগিয়েছে রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তায়নে। যখন দেখছে শত অপকর্মের পরেও দেশ ঠিকই চলে যাচ্ছে তেল বিক্রির টাকায়, তারা অর্থনৈতিক সংস্কারের কোনো প্রয়োজন বোধ করেনি।
রাষ্ট্র চলতে গেলে সবার আগে দৃষ্টি দেয়ার কথা জনগণের মৌলিক চাহিদার দিকে। অন্তত খাদ্য, চিকিত্সা, জীবনের নিরাপত্তা, প্রাথমিক শিক্ষা আর আইনি সুযোগগুলো নিশ্চিত করা না গেলে কোনো রাষ্ট্র টেকে না। আদতে ভেনিজুয়েলা এখন ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের প্রতিচ্ছবি। সেখানে ব্যক্তিগত বিনিয়োগের পাশাপাশি কৃষিকেও নিরুত্সাহিত করা হয়েছে। ভোগ্যপণ্যের সরকারি দাম বেঁধে দেয়ায় কৃষকরা বাধ্য হয়ে ঘরে উঠিয়ে নিয়েছেন তাদের লাঙল-জোয়াল। ভোগ্যপণ্য উৎপাদকদের রাষ্ট্রীয় আইনের মারপ্যাঁচে নির্দিষ্ট মূল্যে পণ্য বেচতে বাধ্য করলে তারাও উৎপাদন থেকে মুখ ফিরিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে রয়েছে। একই ভয়ানক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে ওষুধ খাতও। সেখানে সরকার নিয়ম করে দিয়েছিল নির্দিষ্ট মূল্যে ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে। এখানেও দেখা গেছে, ওই মূল্যে ওষুধ উৎপাদন করা কোনো স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যালসের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে ওষুধ উৎপাদনের চেয়ে কালোবাজারে তার আমদানি করাকেই গুরুত্ব দিতে শুরু করেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, সরকারি দামের আউটলেটগুলোয় তালা ঝুলছে, পর্দার অন্তরালে জমে ওঠে কালোবাজারের ওষুধ ব্যবসা। এক কথায় বলতে গেলে, সরকারি সিদ্ধান্তের দুর্বলতাই খাদের কিনারে নিয়ে আসে দেশটির ফার্মাসিউটিক্যালসসহ প্রায় প্রতিটি শিল্পকে।
আটলান্টিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধে মইজেস নাইম ও ফ্রান্সিককো তোরো দেখিয়েছেন ভেনিজুয়েলার পতনচিত্রকে। ঘুরেফিরে তারা দেখাতে চেষ্টা করেছেন, কীভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে টেক্কা দিতে গিয়ে গর্তে পড়েছে আপাত সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ অনুসরণের চেষ্টাকারী ভেনিজুয়েলা। কেউ কেউ আরেক দফা উত্ফুল্ল হয়ে রণভেরী বাজিয়ে জানান দিতে যাচ্ছেন, ভেনিজুয়েলা সংকট সমাজতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টায় আরেকবার নাড়া দিয়ে বলছে, রুশ বিপ্লবের শবদেহটা এখন কবরে নামানোর অপেক্ষামাত্র। আর চিন্তার সংকটটা ঠিক সেখান থেকেই। বাংলাদেশ কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশ থেকে লাতিন দেশগুলোর যে সংবাদ আমরা পাই, সেগুলোর বেশির ভাগই আসে ইউরোপ ঘুরে। আমরা এগুলো পাই নানা ধরনের সংযোজন, বিয়োজন, সম্পাদনা, পরিবর্ধন-পরিমার্জনের পর। এক্ষেত্রে শুরু থেকে চাভেজ সরকারের পেছনে আদাজল খেয়ে নামা সাম্রাজ্যবাদীরা একটু ফুর্তি ও ঠাট্টাচ্ছলে যে বিশ্লেষণ আমাদের গেলাচ্ছে, হয়তো তার শতভাগ সত্যও নয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র, আইন, নীতি-আদর্শ, অর্থনীতি, খাদ্য ও পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা কিংবা জ্বালানি— সব দিক থেকে দেশটি সম্প্রতি যে এক ভয়ানক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, তা অস্বীকারের উপায় নেই।
গ্রামগঞ্জে পুকুর থেকে রাক্ষুসে মাছ নিধন করার জন্য অনেক সময় সেখানে বিষ ঢালতে দেখা যায়। শোল, গজার, বোয়াল প্রভৃতি রাক্ষুসে মাছকে মেরে ফেলে নতুন করে মাছ চাষ করার জন্যই এমন করা হয়। পুজি সম্প্রসারণে সচেষ্ট সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর কাছে রাশিয়া এক রাক্ষুসে মাছের নাম। বলতে গেলে তারা বিশ্ব অর্থনীতির পুকুরে বিষ ঢেলেছিল রাশিয়াকে মেরে ফেলার জন্য। এক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থে তারা তেলের দাম কমিয়ে দিয়ে রাশিয়াকে যেভাবে জব্দ করতে চেয়েছিল, দিনের পর দিন তাদের ব্যর্থতা এখন বাস্তব। একটু স্পষ্ট করে বলতে গেলে, তাদের হিসাবে বিশ্ব অর্থনীতির রাক্ষুসে মাছ রাশিয়ার কিছুই হয়নি। বরং পুঁজিবাদীদের ঢালা বিষের ক্রিয়ায় এখন জীবন প্রদীপ নিভে যেতে বসেছে ভেনিজুয়েলার মতো চুনোপুঁটিদের। খেয়াল করলে দেখা যায়, ভেনিজুয়েলার অর্থনীতির সবকিছু ছিল তেল ও তার মূল্যনির্ভর। ঠিক যেমনটা বাংলাদেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে শুধু রেমিট্যান্স ও পোশাক শিল্পের ওপর। দিনের পর দিন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা নেচে-গেয়ে পরিসংখ্যান হাজির করছেন, কেউ কেউ অতি উল্লাসে মধ্যম আয়ের দেশে পা রাখার কথা বলছেন। কেউবা হর্ষধ্বনিতে বলতে চাইছেন, দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি কেন নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে একবার ভেবে দেখা প্রয়োজন, যদি বাংলাদেশের রেমিট্যান্স থেকে আয় বন্ধ হয়ে যায় কিংবা পোশাক খাতে ভয়াবহ দরপতন ঘটে, তবে আমাদের অবস্থা হবে ভেনিজুয়েলার থেকেও সঙ্গিন। অন্তত তেলনির্ভর ভেনিজুয়েলার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরও উচিত তেলমর্দনের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা। পাশাপাশি রেমিট্যান্স ও পোশাক খাতের সঙ্গে বিকল্প আয়ের পথ বের করায় মনোযোগ দিতে হবে এখনই।