কল্পকথা কিংবা গল্পগাথায় যে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নাম আমরা শুনেছি, তাঁকে খুব কাছ থেকে না দেখলে চেনা কিংবা বোঝা কঠিন। ভাষাসৈনিক, ইতিহাস গবেষক, আইনজীবী— সব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি একজন বাকপটু নিপাট ভদ্রলোক এবং ভালো মানুষ। সত্য বলতে দ্বিধা নেই, একজন অর্বাচীনের পক্ষে তাঁর মতো গুণীজনের স্মৃতিচারণের দুঃসাহস দেখানোটাই অন্যায়। ব্যক্তি হাবিবুর রহমান স্যারকে অন্তত ছয়-সাতবার দেখার সুযোগ হয়েছিল। এর মধ্যে প্রথমবার তাঁকে দেখেছিলাম বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ তাম্রপ্রস্তর প্রত্নস্থান উয়ারী-বটেশ্বরে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন সবে ভর্তি হয়েছি। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসে হুট করে ইতিহাস কিংবা প্রত্নতত্ত্ব বিষয়টির সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার যে বড় চ্যালেঞ্জ, সেটা নিয়ে ভাবার সময়ও হয়নি। পারতপক্ষে ক্লাস শুরুর আগেই অনেকটা সৌভাগ্যবশত সুযোগ মেলায় মাসখানেকের জন্য মাঠকর্মে চলে গিয়েছিলাম সেখানে। আমার চোখে তখন হাবিবুর রহমান স্যার ছিলেন ‘বচন ও প্রবচন’, ‘লেখালেখি’, ‘যথাশব্দ’, ‘স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন ও বোবার স্বপ্ন’র মতো কয়েকটি গ্রন্থের সুলেখক।
উয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নগ্রামে ঐতিহ্য অনুরাগী হাবিবুর রহমানের আগমন সেদিন সত্যি ধন্য করেছিল তখনকার নবীন গবেষকদের। সেখানে চলমান প্রত্নতাত্ত্বিক খননের নেতৃত্বে ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি পুরোটা সময় স্যারকে নিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন খননে উন্মোচিত নানা ঐতিহ্য নিদর্শন। বর্ষীয়ান এ মানুষটির মনের জোর দেখে অবাক হয়েছিলাম। মাইলের পর মাইল হেঁটে যেভাবে তিনি পুরো প্রত্নস্থল পরিদর্শন করেছেন, অনেক সক্ষম মানুষ হলেও সেটা করতে চাইতেন না। এর পর ক্লাস শুরু হলে ঢাকায় চলে আসি। বিশিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক আবুল কালাম যাকারিয়ার সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম হাবিবুর রহমান স্যার সম্পর্কে। বস্তুত তিনিই আমাকে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছিলেন হাবিবুর রহমান স্যারকে। তাঁর কাছ থেকে শুনেই ‘গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ’ বইটি কিনে পড়েছিলাম। এর পর সময়-সুযোগ মেলায় বেশকিছু অনুষ্ঠানে শুধু হাবিবুর রহমান স্যারের বক্তৃতা শুনতে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এসে বসে থেকেছি। তবে সামনে বসে দীর্ঘ সময় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ তত দিনে হয়ে ওঠেনি।
কিডনি ও ডায়াবেটিসের জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে এক নিকটাত্মীয় ভর্তি হন বারডেমে। রাত জাগার অভ্যাসহেতু সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার মধ্যেও বাধ্য হয়েছিলাম রোগী পাহারা দিতে। পরীক্ষার পড়া বাদ দিয়ে বারডেমের বিশ্রী পরিবেশে নির্ঘুম রাত্রিযাপন নিঃসন্দেহে এক বিরক্তিকর অভিজ্ঞতাই হতে পারত। তবে বিরক্তির বদলে এক অন্য রকম আনন্দের উপলক্ষ হয়ে দেখা দেয় সেখানে হাবিবুর রহমান স্যারের অবস্থান। রোগীদের আর্তনাদে রুমে বসে থাকা দায় দেখে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বারান্দায় বসতে চেয়েছিলাম। রাত দেড়টা হবে, হঠাত্ খেয়াল করি ইনসোমনিয়া সমস্যায় বারান্দায় ঘোরাঘুরি করছেন স্যার স্বয়ং। এগিয়ে গিয়ে সাহসে ভর করে সালাম দিলাম। জানতে চাইলাম, স্যার সঙ্গে কে আছেন? জানলাম তিনি একাই আছেন সেদিন। প্রাথমিক পরিচয় থেকে আলোচনা এত দূর গড়াবে, চিন্তা করিনি। তবে এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, আলোচনাটা শুরু হয়েছিল আবুল কালাম যাকারিয়ার সেই ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ প্রসঙ্গে। প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে যেভাবে পারিবারিক ও সামাজিক গণধিক্কার শুনতে হয়েছিল, তার বিপরীতে আমার কাছে অনুপ্রেরণার নাম ছিলেন ‘আবুল কালাম যাকারিয়া’। এদিকে হাবিবুর রহমান স্যারের সঙ্গে সেদিনের দীর্ঘ আলাপন সত্যি বলতে পথ দেখিয়েছে ভবিষ্যতের পাঠ গ্রহণ ও গবেষণা পরিকল্পনা নির্ধারণের ক্ষেত্রে।
মহাস্থানগড় থেকে শুরু করে পাহাড়পুর কিংবা ষাটগম্বুজ মসজিদ, সোনা মসজিদ আর বারো বাজার মসজিদ কমপ্লেক্স— প্রায় প্রতিটি স্থানের প্রত্ন ঐতিহ্য নিয়ে বেশ ভালো দখল ছিল স্যারের। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষার্থী হিসেবে বছর দুয়েক পার করেও স্যারের বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে রীতিমতো বিপাকে পড়তে হয়েছিল। তবে অন্যদের মতো ধিক্কার না দিয়ে সুন্দরভাবে পরক্ষণে সে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়ায় সুবিধাও হয়েছিল বেশ। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপনের শেষ দিকে শুধু একটা কথাই মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে। আর তা হচ্ছে, স্যার শিক্ষকতা ছেড়ে কেন আইন পেশাতেই স্থির হয়েছিলেন? হয়তো একজন আইনজীবী হিসেবে স্যার অনেক কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা একজন স্পষ্টভাষী, সুস্পষ্ট, প্রাঞ্জল উচ্চারণে বক্তব্য দিতে সক্ষম গুণী শিক্ষককে শ্রেণীকক্ষে পায়নি। বক্তব্যের গভীরতা অনেক পরের প্রশ্ন, স্যারের কাছ থেকে জলদগম্ভীর স্বরে যেকোনো শব্দের স্পষ্ট উচ্চারণ শুনলে শিক্ষার্থীরা মোহিত হয়ে থাকতে বাধ্য— এ কথা অন্তত আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি।
অগণিত গ্রন্থ আর গবেষণাকর্মের পাশাপাশি দেশের মানুষ তাঁকে জানে নৈতিকতা ও সুবিচারের প্রতিরূপ হিসেবে। তিনি অনেক হিসাব ও চিন্তা করে প্রতিটি কাজকর্ম প্রান্তিকে নিয়ে গেছেন। ফলে এগুলো নিয়ে অভাব অভিযোগ থাকলেও সমালোচনা তুলনামূলক কম। দেশের মানুষ তাঁকে একজন বিবেকবান, প্রাজ্ঞ আইনজীবী হিসেবেও শ্রদ্ধা করবে যুগের পর যুগ। দক্ষ ও নীতিবান একজন বিচারপতি হিসেবেও তিনি হয়েছেন সব সমাজে সমাদৃত। তবে আক্ষেপ থেকে যায়, যদি এই গুণীজন শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতেন, তাহলে জাতিকে আরো অনেক কিছু দিতে পারতেন তিনি। অন্তত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে দুস্তর গবেষণার মাধ্যমে সমৃদ্ধ করতে পারতেন ক্ষেত্রগুলোকে। একইভাবে অধ্যাপনা করেও খ্যাতিমান হতে পারতেন একজন আইনজীবী হিসেবে, এখন যেমন আছেন। পাশাপাশি ইতিহাস, ঐতিহ্য গবেষণার প্রচলিত রীতির বাইরে গিয়ে অনবদ্য ও মৌলিক কিছু জ্ঞানও সৃষ্টির সুযোগ হতে পারত তাঁর জন্য। তবে নিজ ইচ্ছেতেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন আইনের পাঠ আর আদালতের প্রাঙ্গণ। হয়তো শিক্ষক হলে তিনি মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে কাজ করে যেতেন অক্লান্ত শ্রমে। তবে বিচারের নিক্তিটা ধারণ করার দায় আরো বেশি। এখানে বিচার-অবিচারের দোলাচলে পাপ-পুণ্যের পাল্লা এদিক-সেদিক হলে কেবল কোনো ব্যক্তি নয়, সমাজেও নামতে পারত ঘোর অন্ধকার। তবে এই অসাধ্য সাধনেও নিজ নামের প্রতি সুবিচার করেছেন হাবিবুর রহমান; নিজ বিবেকের কাছে সত্ থেকে নিয়েছেন প্রায় সব সিদ্ধান্ত, হয়েছেন জননন্দিত এক বিচারপতি।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিতে হয়েছিল তাঁকে। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, অন্য যেকোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার চেয়ে শতগুণ সক্ষমতার সঙ্গে তিনি তাঁর কাঁধে চাপানো দায়িত্ব পালন করেছেন। মানুষ হিসেবে ষোলো আনা সঠিকতার মানদণ্ডে সব নিয়মনীতির পরিপালন হয়তো সম্ভব হয়নি, তবে তাঁর নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে কোনো বিতর্ক আজ অবধি স্পর্শ করতে পারেনি। এ থেকে আমরা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নিরপেক্ষতা, সততা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রতি অবিচল নিষ্ঠার কথা বুঝে নিতে পারি। পাশাপাশি একজন প্রশাসক হিসেবে তিনি কতটা দক্ষ ছিলেন, তারও পরিচয় মিলেছে এর মধ্য দিয়েই। শুধু বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে সময়টা পার করেছেন এমন নয়, বরং গড়ে তুলেছিলেন গতিশীল এক সরকার কাঠামো। সব মিলিয়ে বিচারপতি হাবিবুর রহমান তাঁর অনন্যসাধারণ ব্যক্তিসত্তার ঊর্ধ্বে গিয়ে বহুমুখী প্রতিভার আরেক নাম। বাংলাদেশের এই কৃতী সন্তানের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাঁকে।