অনেক ক্ষোভ নিয়ে এক বর্ষীয়ানকে বলতে শুনেছিলাম, স্কুলের বাচ্চাদের মতো সাংবাদিকদেরও পোশাক থাকা দরকার। ভদ্রলোক মনে করেন, বাংলাদেশের অমর কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্ট চরিত্র হিমুর মতো এ পোশাকের রঙও হবে হলুদ। সেখানে আলখেল্লা, পাঞ্জাবি কিংবা টি-শার্ট কী হবে, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই ওনার। কার সঙ্গে তর্ক হচ্ছে ভাবনা থেকে ঝেড়ে ফেলে তিনি পই পই করে বললেন, ‘মিডিয়া ইজন্ট আ প্লেস ফর দ্য রিফ্লেকশন অব রিয়েলিটি’। ব্যক্তি-গোষ্ঠী, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে এ সময়ে গণমাধ্যমগুলোর যে দুর্দশা, সেখানে এমন হটকারী মন্তব্যের জবাব দেয়াটাও হয়ে যায় বেশ কঠিন। তবে গৌরবময় পেশা হিসেবে সাংবাদিকতার অতীত এখনো সমুজ্জ্বল, উন্নত ও গৌরবে চিরভাস্বর। অনেক আনন্দের সঙ্গে আমরা স্মরণ করতে পারি জাতীয় কবি, তারুণ্য, দ্রোহ, প্রেম ও বিপ্লবের কবি কাজী নজরুল ইসলামও একটা সময় ছিলেন সাংবাদিক। আর স্বভাবসিদ্ধ দ্রোহের তাড়নায় লিখেছিলেন একটি আগুনঝরা সম্পাদকীয়, পত্রিকা বন্ধের পাশাপাশি জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয় ‘নবযুগ’ শীর্ষক সংবাদপত্রটির।
অনলাইন দুনিয়ায় অবারিত তথ্যসম্ভার, সহজ যোগাযোগ ও যাতায়াত থেকে শুরু করে আরো নানা সুবিধা এখন সংবাদপত্রের প্রকাশকে যেমন সহজ করে, অতীতে তেমনটি ছিল না; অবস্থানগত দিক থেকে এর গুরুত্ব ছিল বহুবিধ। অন্তত সংবাদ প্রকাশ ও বিশেষ মতের মুখপাত্র হিসেবে সংবাদপত্রের বিকল্প কোনো মাধ্যম তখন গড়ে ওঠেনি। এমনই বাস্তবতায় ১৯২০ সালের ১২ জুলাই কাজী নজরুল ইসলাম মুজাফ্ফর আহমদকে নিয়ে শুরু করেছিলেন যৌথ সম্পাদনার এক সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ। পত্রিকায় দুই সম্পাদকের নাম নিয়ম করে ছাপার সুযোগ ছিল না। তবে নজরুলের প্রলয়বংশী লেখা মর্মে মাতম তোলে জনতার, তারা প্রথম দিন থেকেই পত্রিকাটিকে ঠাঁই দেয় হূদয়ের মণিকোঠায়। আর তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে নবযুগ তখন হিন্দু-মুসলিম সবার কাছেই জাতি-ধর্ম, সমাজ-সংস্কৃতি ও শ্রেণীভেদ অতিক্রম করে জনপ্রিয় হয়েছিল। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের উত্তাল সেসব দিনে সুস্থ ও ঐক্যবদ্ধ জাতীয় চেতনার বিকাশ স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখাতে পত্রিকাটির অবদান অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অন্তত ভাষা ও সংস্কৃতিগত সংগ্রাম শুরু করে নাগরিক ঐক্যের জোয়ার আনার ক্ষেত্রে এর অবদান অনেক বড় করে দেখা উচিত প্রত্যেক মুক্তিকামী মানুষের।
কবি নজরুল কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে পড়ে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, সেটা অনেক গুরুত্বসহকারে যাচাই করে দেখা প্রয়োজন। অন্তত পাউরুটির দোকান থেকে স্কুল পালানো যুবক, আর লেটোর দল থেকে সেনাবাহিনী, কোথায় দেখা যায়নি চিরবিদ্রোহী-চিরবিপ্লবী নজরুলকে। সবখানে আপন মহিমায় চিরভাস্বর নজরুল তার সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে কেমন ছিলেন, সেটা আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে অবস্থান নিতে পারে অনেকের। আর সেটা বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে সমকালীন আর্থরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিচার-বিশ্লেষণ করাটা বেশ জরুরি। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, তখন চলছে খিলাফত আন্দোলন। বহু মুসলিম ভারত থেকে রক্ত ঝরাচ্ছেন ব্রিটিশদের দমনমূলক মুসলিম নীতির বিরুদ্ধে। তাদের কেউ কেউ ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বেছে নেন স্বেচ্ছানির্বাসনের পথ। অনেকেই মুহাজির বা নির্বাসিত হয়ে চলে যান আফগানিস্তানে।
আফগানিস্তান গেলেই রক্ষা কোথায়? তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে বসে রক্তপিপাসু ব্রিটিশ বাহিনী। নিরস্ত্র মুহাজিরদের অনেককে অমানুষিক অত্যাচার করে হত্যা করে তারা। তাদের দলে থাকা নারী ও শিশুরাও রক্ষা পায়নি ব্রিটিশদের পশুবৃত্তি থেকে।
পরাধীন ভারতে মুখ বুজে সব সয়ে নেয়ার নীতি যেখানে সর্বজনগ্রাহ্য, সেখানে ঘোর অন্ধকারেও আলোকবর্তিকা নিয়ে পথ দেখানো নজরুল বিদ্রোহী প্রদীপের সূক্ষ্ম দীপশিখায় সমুজ্জ্বল। আর সবাই মুখ বুজে সব অন্যায়কে মাথা পেতে নিতে যেখানে অনেকটা অভ্যস্ত, সেখানে নিনাদ করে ওঠে নজরুলের বজ কণ্ঠ, আলোর ঝলকানি দেখা দেয় তার সাহসী কলমে। তিনি এ নবযুগ পত্রিকার পাতায় তুলে ধরেন, ব্রিটিশ বাহিনী কতটা পাশবিক আচরণ করেছে স্বেচ্ছানির্বাসনে আফগানিস্তান যেতে থাকা নিরস্ত্র মানুষগুলোর ওপর। প্রতিবাদ হিসেবে তিনি লিখলেন এক প্রতিবাদী সম্পাদকীয় ‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে?’ অন্তস্থ বর্ণনার পাশাপাশি সংবাদের শিরোনাম দেয়ার ক্ষেত্রে তখন নজরুলের জুড়ি মেলা ভার। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একের পর এক প্রতিবাদী সংবাদে কাঁপিয়ে দিতে থাকেন নিপীড়ক ঔপনিবেশিক লুটেরাদের ভিত। আর সেখানে ঠাঁই মেলে ইরাকের রাজা ফয়সুলের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রও। সেখানে তিনি আবার ব্যবহার করেন একটি গানের কলি— ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার/ পরানসখা ফয়সুল হে আমার।’ নবযুগ নামের এ পত্রিকায় লেখা নজরুলের অসাধারণ ২১টি সম্পাদকীয় ধরনের প্রবন্ধ পরে প্রকাশ পায় ‘যুগবাণী’ নামে। জনমনে তুমুল আলোড়ন তোলা ‘নবযুগ’ বুকে কাঁপন ধরায় সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের। তাদের নীতিনির্ধারকদের তখন বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল পত্রিকাটি। তাই অনেকটা ব্রিটিশদের রোষে পড়ে বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকাটি, বাজেয়াপ্ত করা হয় তার জামানত। বলে রাখা ভালো, নন্দিত বিদ্রোহী কবিতার রচনা করেন নজরুল এ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকতে, যেখানে তার সহসম্পাদক মুজাফফ্র ছিলেন প্রথম শ্রোতা। আর বাংলার বিপ্লববাদীরা কীভাবে সব রকম ভীরুতা-দীনতা থেকে মুক্ত হয়ে সাহস ও স্পর্ধার সঙ্গে এগিয়ে যাবে, তার পথ দেখিয়েছে এক কবিতাই। অন্তত বাস্তবতা লক্ষ করলে নজরুলের সাংবাদিকজীবনেরই অমর সৃষ্ট এটি।
১৯২২ সালের ১৫ মে বার্লিন থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম মুখপত্র প্রকাশিত হয় ‘দ্য ভ্যানগার্ড অব দি ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স’ শিরোনামে। এ পত্রিকা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে গোপনে পাঠানো হতে থাকে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মীর নামে। আর তার মাস দুয়েকের মাথায়ই আত্মপ্রকাশ করে ‘ধূমকেতূ’ নামক রাজনৈতিক কাগজ। প্রতিবাদী পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা এ পত্রিকার নামকরণ নজরুলেরই। ১৯২২ সালের ১২ আগস্ট নজরুলের একক প্রয়াসে সাপ্তাহিক ধূমকেতু পত্রিকা বের হওয়াটা সত্যি এখন ইতিহাস। দ্রোহ ও প্রতিবাদ এবং কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে সমার্থক তা ধূমকেতু পত্রিকার প্রকাশ সার্থক করে তোলে। তিনি শুরু থেকেই এ পত্রিকার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেন ভারতের স্বাধীনতার দাবি। এ পত্রিকা ঘোষণা করে, পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সবাই মিলে শুরু থেকেই ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে।
পত্রিকার কর্ণধার হিসেবে কবি নজরুল তার ক্ষুরধার ভাষায় প্রতিটি বিপ্লবীর রক্তে আগুন জ্বালেন। আর দ্রোহের ধারাবাহিকতায় তিনি ধূমকেতুর ১৩ অক্টোবর ১৯২২ সংখ্যায় লিখলেন ‘ধূমকেতুর পথ’। এ সম্পাদকীয় ধাঁচের রচনা অনেক দিক থেকেই পাথেয় জোগায় মুক্তিকামী বিপ্লবীদের। সেখানে নজরুল কোনো ধরনের আদিখ্যেতার আশ্রয় না নিয়ে সরাসরি লিখেছিলেন ‘…যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশান ভূমিতে পরিণত করেছেন তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা পুঁটলি বেঁধে সাগর পারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তারা শুনবেন না।’ আর এমনই তেজস্বী বক্তব্য ঔপনিবেশিক ভারতে যে বিপ্লবের বীজ উপ্ত করেছিল, তা হয়তো শেষ পর্যন্ত পথ দেখিয়েছে মুক্তিকামীদের।
সম্পাদকীয় লেখার মাধ্যমে সরাসরি বিদ্রোহ করার আগে থেকেই বিপদ ঘনীভূত করেছিলেন নজরুল। ৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ধূমকেতু পত্রিকায় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটির প্রকাশ নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করে অত্যাচারী ব্রিটিশদের। বলে রাখা ভালো, সাংবাদিক নজরুলের প্রতি সম্মান জানিয়েই সদ্য প্রকাশ শুরু হওয়া ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ এটা চেয়েছিল তার কাছে। কিন্তু পরে ভয় করে তারা কবিতাটি ছাপানোর সাহস দেখায়নি। ছত্রে ছত্রে লুটেরা ব্রিটিশদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্রোহের পয়গাম নিয়ে আসা সে কবিতাটি ছিল—
‘আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?
মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি
খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি।
ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা,
মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা।
তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে
রক্ত-তৃষার ‘ময়-ভুখা-হু’র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে।
অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা,
আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা।
দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা
দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা।
‘ময় ভুখা হুঁ মায়ি’ বলে আয় এবার আনন্দময়ী
কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!’
ঔপনিবেশিক ভারতের মতো তখনকার বাংলায় কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতী মানুষের জীবনযাত্রার মান ছিল যাচ্ছেতাই। ন্যূনতম নাগরিক অধিকার তাদের জন্য নিশ্চিত করা যায়নি। এমনই পরিস্থিতিতে শ্রমিক ও কৃষকের পাশে অবস্থান নেয় অনেকগুলো পত্রপত্রিকা। আর বলতে গেলে এ নবযুগ কিংবা ধূমকেতু তারাই মূর্তিমান প্রতিভূ। সেই সঙ্গে বলে রাখা ভালো, নবযুগের মতো ধূমকেতুও প্রকাশ হতে দেখা যায় ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র পক্ষ থেকে। অত্যাচারী ব্রিটিশদের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী সেখানে গিয়ে নিয়মিত হানা দিতে থাকে। স্বদেশী আন্দোলনের নানা বিপ্লবী সেখানে পালিয়ে আছেন এমনি অজুহাতে চলতে থাকে আক্রমণ। আর তাদের হিংস্রতার শিকার হয় পত্রিকাগুলোও। ধূমকেতু পত্রিকা তখন প্রকাশনার মাত্র আড়াই মাসের মাথায় গিয়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করছে। ঠিক তেমনি সময়ে ১৯২২ সালের ৬ নভেম্বর হায়েনার উন্মত্ততায় ব্রিটিশ বাহিনী হামলে পড়ে পত্রিকার দফতরে। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় ধূমকেতুর সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। এদিকে পত্রিকার প্রকাশক মুহম্মদ আফজালুল হককে গ্রেফতার করতে তারা খুব বেশি সময় নেয়নি।
বিশেষ কাজে কবি নজরুল তখন পত্রিকা অফিসে ছিলেন না। তিনি তখন অবস্থান করছেন বিহারের সমস্তিপুর। আর সেখানের কাজ সেরে যান পূর্ববঙ্গে। তার অবস্থানের সংবাদ পুলিশের কানে পৌঁছলে কুমিল্লা শহর থেকে তাকেও গ্রেফতার করা হয়। দেশদ্রোহের অভিযোগে বিচারাধীন অবস্থায় তার ঠাঁই মেলে হুগলী কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে। নজরুলের এ গ্রেফতার মুক্তিকামী ভারতীয়দের জন্য শাপে বর হয়ে দেখা দেয়। কারারুদ্ধ নজরুলের যেখানে শ্বাসরুদ্ধ জটিলতায় স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে ঠিক তার ভিন্ন চিত্র। বিপ্লবীদের জন্মই অত্যাচারের খড়গাঘাত থমকে দিতে; আরেক দফা এ মহাসত্য প্রমাণ করেন কবি নজরুল। দেশদ্রোহের অভিযোগে তাকে জেলে বন্দি রাখা হয় ঠিকই, কিন্তু ব্রিটিশরা আন্দাজও করতে পারেনি কত বড় সর্বনাশ ঘটতে যাচ্ছে তাদের জন্য। তাদের ধারণার অতীত ছিল যে, বিদ্রোহী নজরুলকে দমিয়ে রাখা যাবে না। তিনি কোথায় নিজের বন্দিত্ব থেকে মুক্তির জন্য অনুনয়-বিনয় করবেন; সেখানে সব রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি দাবিতে শুরু করেন আন্দোলন। প্রথমে মৌখিক প্রতিবাদ শুরু করে কাজ না হওয়ায় কারাগারের মধ্যে বিদ্যমান নানা অব্যবস্থার প্রতিবাদে অনশনের পথ বেছে নেন নজরুল।
বাংলার সাহিত্যিক সমাজ নজরুলের মতো প্রতিভার বিরুদ্ধে এমন নির্যাতনের অপঘাত মেনে নিতে পারেননি। খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিঠি লিখে নজরুলকে অনুরোধ করেন এ অনশন ভঙ্গ করতে। একসময় বন্দিদের দাবি মেনে নেয় সরকার; মাতৃসম বির্জাসুন্দরীর অনুরোধে অনশন ভেঙে ফেলেন নজরুল। মাস দশেক কারাভোগের পর বীরের বেশে মুক্তিও পান তিনি। কারাগার থেকে বেরিয়ে দ্রোহ থমকে যায়নি নজরুলের। তিনি নতুন উদ্যমে আত্মনিয়োগ করেন রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও কবিতায়।
দীর্ঘ কারাভোগের পর বেরিয়ে নতুন জীবনের কাজী নজরুল সে সময় নিজ উদ্যোগে কোনো পত্রিকা প্রকাশ করার অবস্থায় ছিলেন না। তবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় চলতে থাকে তার তার ক্ষুরধার-তেজস্বী লেখালেখি। এমন পরিস্থিতিতে ১৯২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’র মুখপত্র হিসেবে প্রকাশ পায় সাপ্তাহিক ‘লাঙল’। তখনকার বাংলাদেশে মেহনতী কৃষক-শ্রমিক ও বিপ্লবী সংগঠকরা সবাই মিলে গড়ে তুলেছিলেন ভারত জাতীয় কংগ্রেসের লেবার স্বরাজ পার্টি বা শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দল। আর জহুরি জহুর চেনে, মেহনতী মানুষ চিনেছিল নজরুলকে। তাই তো এ লাঙলের প্রধান পরিচালকের ভূমিকায় আসীন হন নজরুল এবং সম্পাদকের পদ অলঙ্কৃত করেন মণিভূষণ মুখার্জি। পাশাপাশি প্রকাশকও ছিলেন মণিভূষণই। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যায় সম্পাদকীয় ছিল জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ প্রসঙ্গে।
দ্রোহের নিয়ম হচ্ছে নিয়ম ভাঙার গানে দলে দলে সমবেত হওয়া; লাঙলের মূলমন্ত্র পূর্বনির্ধারিত হওয়ায় এবার দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশ পায় ‘কৃষকের গান’। এ সময় লাঙল পত্রিকার ভাববস্তু ও শব্দচয়নে নজরুল সচেতন সাম্যবাদী। বলতে গেলে বাঁধভাঙা দ্রোহের উন্মাদ প্রদর্শনীর চেয়ে এ পর্যায়ের নজরুলকে দেখা গেছে অনেক পরিণত। দ্রোহের রাজনীতিতে বদলায় সময়, বদলে যান নজরুল। আর কৃষকদের মুখপত্র লাঙল ১৯২৬ সালের আগস্ট থেকে বদলে গিয়ে নাম পায় ‘গণবাণী’। এবার নতুন সম্পাদক নির্বাচিত হলেন মুজফ্ফর আহমদ। এখানেও সমান তালে চলতে থাকে নজরুলের দ্রোহ ও মানবতার জয়গান।
কবিদের মধ্যে কে বাংলা সাহিত্যকে কী দিয়েছেন, সেটা নিয়ে যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণ অনেক কষ্টসাধ্য একটা বিষয়। তবে নজরুলের কবিতা বিশ্লেষণ করে মোটা দাগে বলে দেয়া যেতেই পারে, তিনি বাংলা কবিতায় বর্তমানকে উন্মোচন করেছেন। তিনি কবিতাকে অলীক সাহিত্যরসের গণ্ডি থেকে বের করে এনে নতুনভাবে জীবন দিয়েছেন দ্রোহে উত্তপ্ত বর্তমানের লাভাস্রোতে ভাসিয়ে। তিনি গাইতেন জীবনের জয়গান। তাই তার প্রতিটি রচনা ছিল জীবন্ত বাস্তবতার প্রতিভূ। নজরুল দর্শনে প্রেম-ভালোবাসা, অনুরাগ-বিরাগ, দ্রোহ-বিপ্লব মিলেমিশে যেমন একাকার হয়েছিল, তেমনি আরেক সত্তা সাংবাদিক নজরুলকে এর থেকে আলাদা করার সুযোগ নেই। এসব মিলিয়ে তিনি মেহনতী মানুষের পক্ষে উচ্চৈঃস্বরে অন্যায়ের প্রতিবাদকারী; চিরভাস্বর সবার হূদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই নেয়া প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।