ফেসবুক আলোচনার সূত্র ধরে শেষ পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ মতামতের জন্য বিষয়টি গড়ায় আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক একেএম শাহনাওয়াজ স্যারের কাছে। স্যার সরাসরি নিজেই লিখেছেন এ বিষয়ে– [সাধারণত ফেসবুক পাণ্ডিত্যে আমি নিজেকে যুক্ত করি না। কারণ নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমি সচেতন আছি। আজ একটি বিষয়ে খানিকটা যুক্ত না হয়ে পারছি না। জ্ঞান বিস্তারের সূচনা করেছে আমার ছাত্র সালিম অর্ণব। গিরিশ চন্দ্রের আগে বাংলা ভাষার পবিত্র কোরআন অনুবাদকারীকে আলোতে এনেছে। এটি মূল্যবান অনুসন্ধান। আমি আশা করবো অর্ণব তার গবেষণার পূর্ণতা দেবে। তবে আমার আলোচ্য বিষয় এখানে নয়। এই বাদানুবাদের সূত্রে কে একজন লালমনির হাটের কথিত এদেশে স্থাপিত প্রচীনতম মসজিদ প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেছেন। ব্যাস, এরপর কৌতূহলের বিস্তার ঘটেছে। এভাবে ফেসবুকীয় জ্ঞানের বিস্তার ঘটুক আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু ইতিহাস বিকৃতির আশংকায় আমি শেষ পর্যন্ত লেখাটা দায়িত্বের অংশ মনে করছি।
বেশ কয়েক বছর আগে ইতিহাস মূর্খদের একটি তৎপরতা চোখে পরেছিল। প্রথম আলো পত্রিকায় বড় প্রতিবেদনে জানানো হয় লালমনিরহাটে সাত শতকের মসজিদ আবিষ্কৃত হয়েছে। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের ছাত্র হিসেবে শুনে তো চক্ষু ও মাথা দুটোই চড়কগাছ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের একটি সমস্যা আছে। সাদা চামড়ার কাউকে দিয়ে বলাতে পারলে জাতে ওঠে। তেমনি টিম স্টিল নামের একজন কথিত প্রত্নতত্ত্ববিদকে দিয়ে খোলাফায়ে রাশেদূনের যুগে বাংলায় মসজিদ গড়ার সমর্থন করানো হয়েছে। স্টিল সাহেব আবার তার সমর্থনে ব্যবহার করেছেন আমেরিকার কোনো এক অখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠানের।
তারা রোমান বাণিজ্যের সূত্রে চীন মায়ানমার হয়ে লালমনিরহাটে মুসলমানদের আনিয়েছেন। সেই সূত্রেই আদি মসজিদ। এইসব গল্প যে ইতিহাসের সূত্রে সঠিক হতে পারে না সেসব যুক্তি-প্রমাণে আমি প্রথম আলোকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম এধরণের প্রতিবেদন করতে আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। প্রাচীন বাণিজ্যের সূত্র বললেও কী পাওয়া গেল আর কোন সূত্রে মসজিদ হলো এর কোনো ব্যাখ্যা নেই।

আমি গোলক ধাধায় পরেছিলাম কয়েকটি কারণে ; যেমন, ৮ শতকে সমূদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে মুসলিম বণিকদের প্রথম পদচিহ্ন পরেছিল। সুফিদের মাধ্যমে ইসলামের বিস্তার ধীর গতিতে শুরু হয় ১১ শতক থেকে। ১৩ শতকের আগে উত্তর বাংলায় মুসলমান সুফিদের আগমনের প্রমাণ নেই। তাহলে এতবড় বিভ্রান্তি কেন! আমি টিম স্টেলার খোঁজ করলাম। এদেশে এখনো ইসলাম বিস্তার ও প্রাচীন মসজিদ স্থাপত্য ব্যাখ্যা করার দু একজন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তাদের বাদ দিয়ে প্রথমআলো প্রায় অচেনা টিম স্টিল সাহেবকে দিয়ে অতবড় সনদ আনালো কেন। জানলাম মি. স্টিল কোনো পেশাজীবী প্রত্নতাত্ত্বিক নন। একটি এনজিওতে নাকি কাজ করেন।
আমি মনে করি সিদ্ধান্তের আগে যে কাজ করা উচিত ছিল তা হচ্ছে-১. মসজিদ বলার মত কোনো কাঠামো পাওয়া গিয়েছে কি না, ২. কোনো লিপি ভাষ্য রয়েছে কিনা, ৩. প্রাপ্ত নির্মাণ সামগ্রী পরীক্ষা করে বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে কিনা। দুর্ভাগ্য এর কিছুই করা হয়নি। বাস্তবে যা ঘটেছে তা হচ্ছে আধুনিক মসজিদ বানাতে গিয়ে একটি পুরোনো দেয়ালের অয়শ পাওয়া গিয়েছে। কয়েকটি ইট পাওয়া গিয়েছে, তাতে খুব সহজে পাঠযোগ্য আরবি শব্দ রয়েছে। আল্লাহু লেখা রয়েছে। এটুকুর উপর ভরসা করে রটিয়ে দেয়া হলো সাত শতকের মসজিদ। যেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ হিসেবে মসজিদ কাঠামোর চিহ্নমাত্র নেই।
ঐতিহাসিক কোনো গ্রন্থেরও সমর্থন নেই। আমি লিপি খোদাই ইট দেখে এসেছি। রংপুর তাজহাট জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। দেয় নির্মাণ তারিখ মোটেও ইতিহাসসিদ্ধ নয়। আরবি লিপির ক্রমবিকাশ সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান থাকলে হাসির উদ্রেক হতো। যে যুগের কথা বলা হয়েছে সেসময়ের হলে কুফিক নামের এক জটিল আরবি লিপি থাকতো। আর এই ইটে রয়েছে নাসতালিক ধারার আধুনিক আরবি লিপি। ইটের গঠনও মোগল পরবর্তী যুগের বলে মনে হয়েছে। লেখাটি আর লম্বা করতে চাই না। আশা করি ফেসবুকের জ্ঞানী পাঠকরা বাকীটুকু বুঝে নেবেন।
যে আলোচনার সূত্র ধরে এই বক্তব্য শাহনাওয়াজ স্যার লিখেছেন তা পাঠকের সুবিধার্থে কপি পেস্ট করছি। আনকাট ফেসবুক থেকে কপি পেস্ট করায় ভুলত্রুটি মার্জনীয়।
( ভাই বাঙ্গালী “হাজার বছর” বলার কালপ্রিট পাইলাম এখানে 😆)
জেনে খুশি হবেন হয়তো, এদেশে প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয় রংপুরের লালমনিরহাট।
সব অপ্রয়োজনীয় আলাপ বাদ দেয়ার পরও দেখছি চিন্তার খোরাক আছে। কারন এই রুট তখন আরবীয় বনিকরা ব্যবহার করতো বলে জানি। আপনারা ভালো বলতে পরবেন। তাই জানতে চাইছি।
The inscription Mr. Steel Found is much earlier as it has been suggested. Arabic Inscription expert Professor Emeritus Dr. AKM Yakub Ali already have written a lot about that alongside your work in socio-cultural history of medieval Bengal. As we know Kufic is the oldest calligraphic form of the various Arabic scripts of that time the Mosque supposed to built within. As that inscription consists of a modified form of the old Nabataean script it may be older all alone. However that inscription in not representing that particular period of time. So far so good is is not the oldest one in Bangladesh.
টিম জানতে পারলেন, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পাড় ধরে সিকিম হয়ে চীনের ভেতর দিয়ে আরব বণিকদের বাণিজ্যবহরের যাতায়াতের অনেক প্রমাণও টিমের হাতে আসে। টিমের গবেষণায় আরও প্রমাণ মেলে খ্রিষ্টপূর্ব সময় থেকে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা দিয়ে চীন ও ভারতবর্ষ থেকে রোমান ও আরবরা পণ্য নিয়ে যেত। রোমানদের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগের আরও প্রমাণ তিনি পান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফুির রহমানের ওয়ারি-বটেশ্বর সভ্যতা নিয়ে গবেষণায়। নরসংদী থেকে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে প্রাচীন নগর-সভ্যতার যে নিদর্শন মোস্তাফিজুর রহমান পেয়েছেন, তাতে এটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে পড়ছে, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা বাংলাদেশ ভূখণ্ডে গড়ে উঠেছিল।