শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতগুলো শরীরে দাগ রেখে যায় এক মহাকালের প্রতীতিতে। পথ চলতে, পথে চলতে মানুষের এমনি অর্জন-বর্জন, ঘাত-প্রতিঘাত কিংবা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে সংগ্রামী দিনের যে স্মৃতিচারণ ক্ষেত্রবিশেষে তা এক ও অভিন্ন হয়ে দেখা দিতে পারে। আসমান এমনি এক জীবনের গল্প, সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত কথকতায়, কল্পকথায় কিংবা গল্প গাথায় মিলেমিশে একাকার হয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে ‘এ গল্প জীবনের চেয়েও বড়’। এক আঁধার কখনও অন্য একটি আঁধার তাড়াতে পারে না। সে আঁধার হৃদয়, মন কিংবা জীবনের মত পৃথিবীর যেকোনো বাস্তবতায় হোক না কেনো?
আসমানের এক পর্যায়ে গিয়ে কার্ল মার্ক্সকে উদ্ধৃত করা হয়েছে ‘রিলিজিওন ইজ অপিয়াম ফর দ্যা পিপল।’ ধর্মের নির্দেশ এবং যাপিত জীবনাচারের মধ্য থেকে নতুন এক সত্তার আবিষ্কার করতে গিয়ে বিশ্বাস-বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে খাবি খেতে দেখা যায় উপন্যাসটির মূল চরিত্রকে। কার্ল মার্ক্স এর উদ্ধৃতি নিয়ে সেখানে বিশ্বাসকে বাস্তবতার মুখোমুখি এনে দাঁড় করানো হয়েছে এভাবে– ‘হুজুরের কাছে গেলাম তিনি আফিম খাওয়ালেন, তোর কাছে আসলাম তুই এখন গাঁজা খাওয়াবি। হুজুরের ধর্ম আফিম আর তোর ধর্ম গাঁজা। হুজুর আমার নতুন বন্ধু তুই আমার পুরাতন বন্ধু, কোনটারে ছাইড়া কোনটা ধরি। মুসকিলে পড়লাম দেখি।’ তবে এভাবে বললেও তার মাঝে একরকম পরিবর্তন দেখাতে চেয়েছেন লেখক। তাঁর চিন্তায় যে বিমূর্ত পরিবর্তন তা মূর্ত হয়ে ধরা দেয় জ্বলন্ত গাঁজার স্টিকে লম্বা টান দিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকা রুশোর কথার মধ্য দিয়ে।
চিরচেনা বন্ধু হঠাৎ অচেনা হয়ে যাওয়ায় তার চোখে ধরা দেয়া যে পরিবর্তন সেটাই লেখক দেখাতে চেয়েছেন এক জীবনের গল্প হিসেবে। এই গল্প চিরচেনা জগৎকে অনেকটাই অচেনা করে তোলে, একান্ত আপন মানুষকে যেমন দূরে ঠেলে দিতে পারে তেমনি কাছে টানতে পারে অচেনা কাউকে। নন্দিত লেখক পাওলো কোয়েলহোর উপন্যাস থেকে শুরু করে শাহরুখ খানের হিন্দি ছবি ‘ওম শান্তি ওম’। প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রণেয়োপাখ্যানের সূচনাপর্বে একই রকম চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। শাহরুখ বলছে ‘আগার কিসি চিজকো তুম দিলছে চাহতি হো, তো সারে কায়েনাত তুমহে উসে মিলানে কি কোশিশ মে লাগ জাতি হ্যায়’। সেখানে বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ আলকেমিস্টে কোয়েলহো বলছেন ‘যদি তুমি কোনো কিছু অন্তর থেকে চাইতে পারো তবে দেখে নিও একদিন পুরো দুনিয়া তোমাকে তা পাইয়ে দিতে আদাজল খেয়ে লাগবে’। তবে এই চাওয়া আর পাওয়ার যে ফারাক সেখানে ‘বিশ্বাস’ এবং ‘বাস্তবতা’ নামে দুটি শব্দকে আলাদা করে চেনার সুযোগ হয়েছে। এই সুযোগে মান, জ্ঞান এবং হুশ থাকার সুবাদে মন ও মননে পুরো একটা পশুকে বয়ে বেড়ালেও কেউ কেউ মানুষ নামে পরিচিত।
এমনি করেই মানুষ নাকি তার সাথে করে একটা চিড়িয়াখানা নিয়ে ঘোরে। তার প্রয়োজন অনুসারে সে একটা করে প্রাণীকে প্রদর্শন করে অথবা কাজে লাগায়। ‘কখনো সে বাঘ কখনো সে হায়েনা কখনো সে গরু ঘোড়া অথবা গাধা, কখনো সে বিষাক্ত সাপ’। লেখক অবচেতন মনের অবগাহনে বলতে চেয়েছেন ‘মানুষ যতক্ষন জেগে থাকে ততক্ষন সে এই চিড়িয়াখানাটা সামলাতে ব্যস্ত থাকে। চিড়িয়াখানা সামলানোর এই ব্যবস্থাপনা যার যত ভালো সে তত ভালো মানুষ। খারাপ মানুষেরা আসলে তাদের চিড়িয়াখানা ব্যবস্থাপনায় খারাপ, আর বেশি খারাপ যারা তারা তাদের চিড়িয়াখানার সকল প্রাণীর দরজা খুলে রাখে। তার সে সব ক্ষুধার্ত আর হিংস্র প্রাণীরা মানুষ, সমাজ আর রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে ঝাপিয়ে পড়ে। মানুষ যতই আধুনিক হোকনা কেন, এখনও তাকে জীব জন্তুর সাথে লড়াই করতে হয়।’ মানুষ হিসেবে কাউকে বেঁচে থাকতে গেলে এই লড়াই তাকে করতে হয় অন্য কারো সঙ্গে নয় বরং নিজের সঙ্গে। আর সে লড়াইয়ে যে হেরে যায় লেখকের ভাষ্যে সে অসভ্য বা ইতর।
সভ্য মানুষকে বিশ্বাস ও বাস্তবতার মাঝামাঝি দাঁড় করিয়ে রাখা তত্ত্বকথাগুলো এক অর্থে লড়াইনির্ভর। ডারাউনিজম বলছে ‘স্ট্রাগল ফল এগজিস্টেন্সের’ লড়াইয়ের কথা, জীবন বিজ্ঞান বলছে শুক্রাণুর সঙ্গে ডিম্বানুর মিলনের আগের লড়াই নিয়ে, ইহুদিবাদ জানান দিচ্ছে ‘কিংডম অব হেভেনের লড়াই’, খ্রিস্টধর্মের ক্রুসেড কিংবা ইসলামের জিহাদ এও তো এক অর্থে লড়াই-ই। আর বাস্তব দুনিয়ায় নাম সর্বস্ব এজটি রাজনৈতিক দল পর্যন্ত রাস্তায় নেমে শ্লোগান দিচ্ছে ‘.. লড়াই লড়াই লড়াই চাই লড়াই করে বাঁচতে চাই। এত লড়াইয়ের ভিড়ে লেখকের ভাষ্যে ‘মানুষের লড়াই মূলত ইতর প্রাণী আর অসভ্যতা থেকে মুলতঃ সভ্য হওয়ার লড়াই। নিজের ভেতরে লড়াই। নিজের পশু প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই।’
কারো কারো বিশ্বাস যেমন, একদিন তারা ‘চর দখলের মত নিজের আয়ত্বে নেবে পৃথিবীর সবটুকু রোদ’ তেমনি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ লড়াই অপ্রাসঙ্গিক। সেখানে বড় হয়ে উঠছে ‘স্ব স্ব কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম’। উপন্যাসের ধারাক্রমে উপনিবেশবাদ, সম্প্রসারণবাদ কিংবা সা¤্রাজ্যবাদের কথা যেভাবে এসেছে ক্ষেত্রবিশেষে ‘আসমান’ আর উপন্যাস থাকেনি, হয়ে গেছে সত্য ঘটনার একটা ধারাবিবরণী। তাইতো জিম মরিসন থেকে আমাদের লালন শাহ, ভৌগোলিক দূরত্ব আর ভাষার পার্থক্য ছাপিয়ে মিলেমিশে একাকার একই বইয়ের মলাটে। লালন থেকে শুরু করে জিম, যাকেই যেভাবে দেখা হোক মূল্যায়নের ক্ষেত্রটা হওয়া উচিত অভিন্ন। এখানে লালন কিংবা জিম নিজে কি চাইতেন, তার ভক্তরা কিভাবে একজন সত্তা ‘লালন’ অথবা ‘জিম’ কে উপস্থাপন করছে এবং ভক্তদের বাইরে অন্য মানুষের কাছে তাদের সম্পর্কে ধারণা কেমন; সেই অনুচ্চারিত এবং বিমূর্ত সত্য এখানে মূর্ত হয়েছে অদ্ভুত ধারাবাহিক এক লেখনীর মধ্য দিয়ে।
এবং প্রেম…! উপন্যাসের এক পর্যায়ে এসে প্রেয়সী লামিয়ার প্রতি অন্ধপ্রেম আত্মহননের দিকে ঠেলে দেয় যে যুবককে তার হাত ধরেই পাঠকের পরিচয় ঘটবে ক্ষ্মীনদৃষ্টির একটা কুকুরের সঙ্গে। তার ঘোলাটে দৃষ্টিরেখায় অদৃশ্য পাউরুটির টুকরোগুলোকে দৃশ্যমান করার চেষ্টায় বিভোর ছেলেটির চিন্তাকে ছাপিয়ে ট্রেন মিস করার গল্প স্মরণ করিয়ে দিতে পারে পরপারে গমনের বাস্তবতাকে। তবে এখানে গল্প ভিন্ন। ঘোলাটে দৃষ্টির কুকুরটিকে টুকরো করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে রুটি খাওয়াতে গিয়ে ছেলেটি কুকুরের জীবন বাঁচালো নাকি ঐ কুকুর আদতে তাকে সরিয়ে রাখলো আত্মহননের ভয়াল কৃষ্ণবিবর থেকে? প্রেয়সী লামিয়ার থেকে তার কাছে বড় হয়ে ওঠে একটা ঘিয়ে ভাজা কুকুরের ভালবাসা যে তখন তার পায়ে নাক ঘঁষতে শুরু করেছে। সে বুঝতে পারে কারো না কারও জন্য হলেও এই পৃথিবীকে তার প্রয়োজন রয়েছে।
চারদিক আঁধারে ঘিরে গেলে সীমান্তের দিকে এক ঝলক আলোকরশ্মি অনেক বড় হয়ে উঠতে পারে। জীবনধর্মী এ উপন্যাসে ভাগ্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য নেয়া হয়েছে অন্ধকারের অদ্ভুত অবয়ব থেকে। এরপর ঘুরে ফিরে ধর্ম সংস্কার আন্দোলন। পাওলো কোয়েলহোর উপন্যাসে লাতিন আমেরিকার যে বাস্তবতা ফুটে উঠতে দেখা যায় সচরাচর, এখানকার প্রেক্ষাপট অনেকটা তেমনি। তাই সমকালিন বিশ্বের উপন্যাস সম্পর্কে উপযুক্ত ও যথাযথ জ্ঞানের অভাব নিয়ে বিষয়ের ভূল ব্যাখ্যায় ‘আসমান’ কে ধর্মীয় উপন্যাস বলার কোনো সুযোগ নেই। এখানে ধর্মীয় পরিস্থিতি ব্যখ্যার নামে যেটুকু বিষয়ের অবতারনা তা এক অর্থে বাংলাদেশ ও বর্তমান বিশে^র সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা। আর সমাজ-সংস্কৃতি যদি বর্ণনার মধ্য দিয়ে জীবন্ত নাই হয়ে ওঠে, মানুষ যদি সেখানকার চরিত্রগুলোকে তার কাছে চিরচেনা ভাবতে না পারে তবে সেটা আর যাই হোক সার্থক উপন্যাস নয়। বাস্তব ঘটনার পাশাপাশি কাল্পনিক কিছু চরিত্রকে আশ্রয় করে সামাজিক-সাংস্কৃতি
ক প্রেক্ষাপটের রূঢ় বাস্তবতাকে তুলে ধরতে পারাটাই আসমানের সফলতা। তাই একদিক থেকে ধরতে গেলে আসমান উভয় সংকটে পড়া এক যুবকের জীবনের গল্প, তবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় যাচাই করলে এ গল্প জীবনের চেয়েও বড়।