পুরাণের পাতা থেকে বাস্তব। সেই গরু আর এই গরুতে অনেক ফারাক। আমরা ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের পঞ্চম সূক্তে অগ্নিকে উদ্দেশ করে বলতে দেখি ‘… বৃষভশ্চ ধেনুঃ’। এদিক থেকে ধরতে গেলে বেদের ভাষ্য অগ্নি একাধারে ষাঁড় ও গাভী দুই-ই। আর বর্তমানে গরু ও অগ্নির সম্পর্ক কেবল বাজারদরে। অর্থাৎ কিনা গরুর দামে লেগেছে আগুন। গো-মাংসের বাজারদর ২০০ থেকে বেড়ে ৫০০-এর কোটায় উপস্থিত হতে অর্ধযুগও পার করতে হয়নি। আরেক দফা ঋগ্বেদে দৃষ্টি দেয়া যাক। এখানে দশম মণ্ডলের বায়াত্তর সূক্তে সোমের আরাধনায় তাকে তুলনা করা হচ্ছে ‘… প্রিয়ঃ পতিগর্বাং’, যার অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘তিনি গরুদের অধিপতি’। এভাবেই সূর্যকে বলতে দেখা গেছে উজ্জ্বল বর্ণের ষাঁড়তুল্য সত্তা। দেবরাজ ইন্দ্রকে পরিচয় করাতে গিয়ে বেদে উল্লেখ করা হয়েছে ‘…সুদুগ্ধা ধেনু’। বদলেছে সময়, কৃষিভিত্তিক সমাজের পরিবর্তন আর নগর সভ্যতার পত্তন গরুকে ব্রাত্য করে তুলেছে সময়ের আবর্তে।
দূরত্ব শৈশবের হাভাতে স্মৃতি হাতড়ে দেখতে গেলে তাই তো ‘মাঠের গরুর বাইরে আরেক বিশেষ গরুর নাম মনে পড়বে’। আর কেউ মনে করুক আর না-ই করুক, গরুকে নিত্যদিন স্মরণ করতেন স্কুল শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীদের পাঠে সামান্য মনোযোগহীনতা নজরে এলেই তাঁরা একটু কটুকথা বলতে যা উচ্চারণ করতেন, সেখানে সবার আগে উচ্চারিত পদবন্ধ ‘… এই গরু’, নয়তো ‘বেয়াদপ ছেলে, ষাঁড়ের মতো বড় হয়েছ, ঘটে একটুখানি বুদ্ধি নেই’। দিনানুদৈনিকতায় এমন শব্দের উচ্চারণ শুনতে গিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত কেউ যখন সাহিত্যের পাতায় চোখ বোলাতে যাবেন, সেখানেও হতশ্রী দশা গরুর। দীনবন্ধু মিত্রের বিখ্যাত নীল দর্পণ নাটকেও জনৈক ইংরেজ কর্মকর্তাকে তুচ্ছার্থে এক কৃষককে গালি দিতে দেখা গেছে ‘শালা পাজি, গরুখোর’ বলে। তাই কৃষিভিত্তিক বৈদিক সমাজে গরুর যে কদর, সেটা সময়ের সঙ্গে গুরুত্বই শুধু হারিয়েছে এমন নয়।
লাঙল দিয়ে চাষ বন্ধ হওয়ার পর থেকে খাবার টেবিলের শোভা বর্ধনে কিংবা রসনায় গুরুত্ব বেড়েছিল গরুর। আধুনিক ‘বিফ স্টেক’, ‘বিফ ভিন্দালু’, ‘বিফ সাসলিক’, ‘বিফ বেবিকর্ন’, ‘গ্রেভি বিফ চিলি’ এগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের কাবাব তো রয়েছেই; গ্রামবাংলায় বিয়ে থেকে শুরু করে শেষকৃত্য, এমনকি খতনার মতো নানা অনুষ্ঠানও অসম্পূর্ণ থেকে যেত ধোঁয়া ওঠা মাংসের ঝাল তরকারি বাদে। ফলে একটা পর্যায়ে এসে দেখা গেছে, গ্রামবাংলার মানুষ মোটরবাইক বলতে যেমন হোন্ডাকে চেনেন, স্যান্ডেল মানে যেমন বাটার নাম আসে, তেমনি খাবার মাংস বলতে সেটা গো-মাংসের নামান্তর। বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর আমিষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি উত্সব আয়োজনেও অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে যায় এই গরুই। ফি-বছর ঈদুল আজহায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর যে কোরবানির আয়োজন, সেখানেও শীর্ষে থাকে এই গরুই। সবদিক থেকে হিসাব মেলাতে গেলে গরুর গুরুত্বকে খাটো করে দেখার সুযোগ ছিল না। অন্তত বিশ্বের সবচেয়ে কম আমিষ খাওয়া জাতি হিসেবে যে দশটা দেশের নাম এসেছে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ নিচের দিকেই। সেখানে অল্পবিস্তর আমিষের সিংহভাগই আসতে দেখা যায় গো-মাংস থেকে।
বিশাল জনগোষ্ঠীর মাংসের চাহিদা মেটাতে যে পরিমাণ গরু প্রয়োজন, একটা পর্যায়ে এসে বাংলাদেশের পক্ষে সেটা সামাল দেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আমদানির দিকে ঝুঁকতে হয়েছিল। পৌরাণিক যুগে গরু নিয়ে যে ‘গভিষ্টি’ বা ‘গব্যু’-এর মতো লড়াই হতো, এবার তেমনি লড়াইয়ে কুপ্রভাবের শিকার বাংলাদেশ। বলতে গেলে হঠাৎ আমদানি বন্ধ হয়ে গেলেও চাহিদা একরত্তি কমেনি গো-মাংসের, ফলে এক লাফে দাম বেড়ে দ্বিগুণের মতো হওয়াটা আর যা-ই হোক অবাক করে না। সিন্ধু সভ্যতার সিলে উত্কীর্ণ ষাঁড়ের প্রতিকৃতি থেকে কারওয়ান বাজারে ঝোলানো ‘গো-মাংসের মূল্যতালিকা’, এর দুটোই এখন দুর্বোধ্যতার দোলাচলে আচ্ছন্ন। মহাকালের প্রতীক্ষা, গো-মাংসের দাম কমবে কবে, নাকি মূল্যস্ফীতির যে ইঁদুর দৌড়, সেখানে অতলস্পর্শী অবস্থানটাই চিরস্থায়ী হবে এক্ষেত্রে।