অর্থনৈতিক অস্থিরতার রাজনীতি এখন যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে পুরোপুরি জনতার রায়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ পরিবর্তন ধারাবাহিক হলে একটা পর্যায়ে এসে পুরো পরিস্থিতি বদলে যেতে দেখা যাবে। সেখানে বিচার-বুদ্ধির বদলে অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। অভিবাসনবিরোধী নীতি আরো পোক্ত হয়ে ওঠার ব্যাপারটা স্বাভাবিক বলে মনে হবে। তার পর পুঁজিবাদ, বিশ্বায়ন ও গণতন্ত্রের মতো বিষয়গুলো আলোচনায় এলেও আসতে পারে।
ইতিহাসের এ সময়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে গেলে তার বহির্পতন নিশ্চিত, আর সেটিই হচ্ছে এখন। তবে দ্রুত অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠার মাধ্যমে বাস্তবসম্মত অবস্থার সৃষ্টি হবে— এমনটিই ভাবা হচ্ছে। নয়া উদ্ভাবনের পাশাপাশি ডেমোগ্রাফিক্সকে এখন হেডউইন্ড মনে করা হয়, টেলউইন্ড নয়। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ বা প্রবৃদ্ধি-সংশ্লিষ্ট চলকগুলো উপযুক্ত সমাধান দিতে পারছে না।
গৃহযুদ্ধের পরবর্তী ১০০ বছর পর মার্কিনিরা পার করছেন সবচেয়ে নীতিভ্রষ্ট সময়। এখন এনার্জি, ইলেকট্রিফিকেশন, টেলিকমিউনিকেশন ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন পুরো সমাজ কাঠামোকে নতুন করে গড়ে দিয়েছে। মানুষের জীবন এখন হয়ে উঠেছে অনেক উৎপাদনশীল, পাশাপাশি নাটকীয়ভাবে তাদের প্রত্যাশাও বেড়েছে বহুগুণে। ১৮০০-১৯০০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। গত ৫০ বছরে এ সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। অর্থনীতিও বড় হয়েছে। এর পর ১৯৭০ সালের দিকে একটি পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। ঋণের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে যখন পশ্চিমা অর্থনীতি ধুঁকতে শুরু করেছে তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড রিগ্যান কিংবা ফেডারেল রিচার্ভের চেয়ারম্যান অ্যালান গ্রিনস্প্যানরা কূলকিনারা খুঁজতেই দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন। তত দিন বিশ্বের ধারদাতা হিসেবে পরিচিত ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ধীরে ধীরে তারাও ধার নিতে শুরু করে। তারা বাণিজ্য ঘাটতি পুষিয়ে নিতে অনেক দেশ, এমনকি চীনের সঙ্গে পর্যন্ত চুক্তি করে। এমনই নানা পদ্ধতিগত বদল গত ৩০ বছরের অর্থনৈতিক কাঠামোকে বদলে দিয়েছে।
২০০৮ সালের পর বিশ্ব অর্থনীতিতে একটা অচলাবস্থা লক্ষ করা যাচ্ছে, যেখানে ফিন্যান্সিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো প্রত্যয় জনপ্রিয় হতে দেখা গেছে। নীতি-নির্ধারকরা প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গীন অবস্থা থেকে বিবিধ নীতিনির্ধারণী জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এমন পরিস্থিতিতে সামান্য আয়ে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাচ্ছেন। ধনীরা আরো ধনী হচ্ছেন। জীবনযাত্রার মানে অবনমন ঘটছে। দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরা ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
প্রতিটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুনাফার দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে। এক্ষেত্রে সেই জনসংখ্যার দিকে নজর দিতে দেখা যাচ্ছে, যারা উপযুক্ত কাজের সন্ধানে চিত্কার করে বেড়াচ্ছে। চীনসহ অন্যান্য দেশে আয়ের বিপরীতে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান বিশ্বের উন্নয়নকামীদের বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আফ্রিকায় জনসংখ্যার লাগামহীন বৃদ্ধি। উপরন্তু এটি মনে করার কোনো সুযোগ নেই যে, প্রযুক্তির নানা উদ্ভাবন সব গণেশ উল্টে দিয়েছে। বিকিকিনির ক্ষেত্রে ইউবার বা অ্যামাজন প্রভাব বিস্তার করছে। রোবোটিকস কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ বদলে দিয়েছে প্রভৃতি নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে এর কারণে কর্মজীবী অনেককে তাদের কাজ ছেড়ে যেতে হয়েছে কিংবা তাদের বেতন কমেছে।
এটিকে ‘ক্রিয়েটিভ ডেসট্রাকশন’ প্রত্যয় দিয়ে সহজেই সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। জোসেফ সুম্পিটার এটি নিয়ে আগেও অনেক আলোচনা করেছেন সেখানে অ্যামাজন বা ওয়ালমার্ট ইস্যুতে নানা বিষয় স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে, যা নিয়ে নতুন করে বলারও কিছু নেই। এক্ষেত্রে মাত্র তিন দশক আগে ওয়ালমার্ট যে কাজগুলো করত, সেখানে প্রযুক্তির স্পষ্ট ব্যবহার ছিল। তাদের থেকে আরেক ধাপ এগিয়ে অ্যামাজন এখন তাদের বাজার দখল করে নেয়ার পথে। জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন তথা উন্নয়ন নিত্যনতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ১৯৮৭ সালের দিক থেকে এ বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছেন রবার্ট সলো। তিনি সবখানে কম্পিউটার যুগের আবির্ভাবের কথা উল্লেখ করেছেন, যাতে উৎপাদনশীলতা ভালোভাবে বোঝা সম্ভব।
নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রবার্ট গর্ডন বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতার সম্পর্ক নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। তিনি এক্ষেত্রে বিদ্যুতের উদ্ভাবন থেকে শুরু করে আরো নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে তা বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। তবে প্রারম্ভিক পর্যায়ে সুম্পিটার যে সাইকেল অব ইনোভেশন নিয়ে কথা তুলেছেন, এর ধ্বংসাত্মক পরিণতি নিয়ে সতর্ক থাকার বিষয়টিও এ বিশ্লেষণ থেকে বাদ যায়নি। এদিকে প্রযুক্তিগত উত্কর্ষ যেভাবে কাজ সহজ করেছে, তার বিপরীতক্রমে হ্রাস করেছে কর্মসংস্থানও। ফলে প্রবৃদ্ধির হিসাবে এ বিষয়ও বিবেচনায় নেয়া উচিত। এক্ষেত্রে সুম্পিটার কিংবা গর্ডন যদি সঠিকও বলে থাকেন, তাদের কিছু করার নেই। কারণ ক্রুদ্ধ ভোটারদের মনে যা কাজ করেছে, সেখানে কোনো বিশ্লেষকের কথা কিংবা পণ্ডিতের বক্তব্যে চিড়া ভেজার কোনো সুযোগ নেই। কারণ যাদের জীবন এখন বিপর্যস্ত, তারা এর থেকে উত্তোরণের চেষ্টা করেছে, বেশি কিছু বোঝার ইচ্ছা ছিল না তাদের।
কেইনসিয়ান চাহিদা ব্যবস্থাপনা দিন শেষে তাদের জন্য কতটুকু সুখকর হয়ে উঠছে, তা এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। এক্ষেত্রে মুদ্রানীতি থেকে শুরু করে অর্থ ব্যবস্থা— প্রতি ক্ষেত্রেই পরিবর্তনের সুর। ইউরোপ থেকে আমেরিকা সবখানে একই চিত্র। ব্রেক্সিট আর যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের বিজয় রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এক পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে।
থমাস ডাইলন বাজার ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে রাতারাতি গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাতে নারাজ। এক্ষেত্রে বিশ্বপুঁজি ব্যবস্থার ভঙ্গুর দশা থেকে উত্তরণে কাজ করতে প্রত্যাশী তারা। এখনকার শ্লথ হয়ে আসা প্রবৃদ্ধি কিংবা রাজনৈতিক পশ্চাত্পদতাকে একটু নতুনভাবে দেখতে চান তারা। এ ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন তাদের হতে হয়েছিল সেই ১৯৩০ সালের দিকে। আইসোলেশনিজম কিংবা প্রটেকশনিজম থেকে এ যুগের কেউ মুক্ত নন।
গ্যাম-এর সিইও এবং বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার