মহামারী প্লেগ যখন ব্ল্যাক ডেথ নামের আর্তনাদে রূপ নেয় তখন পুরো বিশ্বের মানুষ তার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করে। নিরুপায় হয়ে মানুষ বিশ্বের নানা স্থানে সমবেত হয়ে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করতে থাকে। মানুষ তখনও ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়াকে শনাক্ত করতে পারেনি বলে দায়ী রেছে কখনও দূষিত বাতাসকে। ক্ষেত্রবিশেষে ধিক্কার দিয়েছে তাদের ভাগ্যকে কিংবা মনে করেছে স্রষ্টা তাদের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন। তারা বিভিন্ন প্রেত সাধনা ও অশরীরি আত্মার প্রভাব বিশ্বাস করায় তাদের মনে বদ্ধমূল ধারণা হয় অশক্তির প্রভাবে এই রোগ ছড়াচ্ছে। তারা কেউ চিন্তাও করতে পারেনি দৃশ্যমানতার থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোনো জীবাণুর পক্ষে এমন ভয়াবহ রোগ ছড়ানো সম্ভব। ফলে তারা সমবেত প্রার্থনা কিংবা শোক উৎসবে যখনই জড়ো হয়েছে সেখান কয়েকগুণ বেশি দ্রুততায় বিস্তার লাভ করেছে এই মহামারী। ১৩৪৯ সালে ব্ল্যাক ডেথের ভয়াবহতা থেকে গুজব সৃষ্টি হয় যে ইহুদিরা এই রোগ ছড়িয়েছে। তারা রোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্ব থেকে খ্রিস্টানদের নামা নিশানা মুছে দিয়ে নিজেদের আধিপত্য নিশ্চিত করতে চায়। ইউরোপের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়া গুজব একটা পর্যায়ে এসে গণহত্যায় রূপ নেয়।
প্রথম দিকে গুজবকে মানুষ তেমন আমলে নেয়নি। কিন্তু একটা পর্যায়ে তারা আঁচ করতে থাকে ইউরোপের খ্রিস্টানরা যেভাবে প্লেগে আক্রান্ত হয়েছে তার তুলনায় ইহুদিদের মধ্যে সংক্রমণ নেই বললেই চলে। এর পেছনে অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকলেও খ্রিস্টানরা সেটাকে আমলে নেয়নি। ক্রুসেডের মাধ্যমে নির্বিচারে মুসলিম হত্যার অভিজ্ঞতা তারা নতুন করে ঝালিয়ে নেয় ইহুদিদের উপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে। ইহুদি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় স্বাভাবিকভাবেই সমাজের অন্য মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। তারা আক্রান্ত কিংবা মৃত কোনো খ্রিস্টানের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করায় অনেকটা নিরাপদ থাকে প্লেগ থেকে। চোলাই মদ কিংবা ঐ ধরণের পানীয় থেকে তারা দূরে থাকতো। অন্যদিকে ইঁদুর কিংবা শুকরের মতো রোগ বিস্তারকারী প্রাণির সংস্পর্শ থেকেও তারা দূরে ছিল। পাশাপাশি গোসলের ক্ষেত্রে এক রকম বাধ্যবাধকতা থাকায় তারা অনেকটাই পরিচ্ছন্ন থাকতে পেরেছে। ফলে যে প্লেগ ইউরোপের খ্রিস্টানদের প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিতে বসেছিল তার থেকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ থাকে ইহুদিরা। ফলে যখন সুইজারল্যান্ড থেকে গুজব রটে যে জনৈক ইহুদি কুয়ার মধ্যে বিষ ঢেলে দিয়ে এই রোগ ছড়িয়েছে তখন তা ইউরোপের বেশিরভাগ সাধারণ খ্রিস্টান বিশ্বাস করে।
ক্যাথলিকদের স্বর্গরাজ্য জেরুজালেম দখলের ব্রত নিয়ে তারা যে ক্রুসেড শুরু করেছিল ব্ল্যাক ডেথ তাকে অনেকটা থমকে দিয়েছিল। এবার এই রোগ সৃষ্টির পেছনে ইহুদিদের জড়িত থাকার গুজব ছড়িয়ে পড়লে তারা নতুন করে হাতিয়ার তুলে নেয়। তারা ইউরোপের নানা স্থানে ইহুদীদের বসতিগুলোকে আক্রমণ করে বসে। মুগুর এবং কুড়াল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া খ্রিস্টানদের নৃসংসতা প্লেগের ভয়বহতাকে ছাপিয়ে যায়। তারা প্লেগ থেকে নিরাপদ থাকায় বেছে বেছে বিভিন্ন ইহুদি পরিবারের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে। উদাহরণ হিসেবে স্ট্রসবার্গ গণহত্যার (Strasbourg massacre) কথা বলা যায়। মনে করা হয় এই গণহত্যায় একটি কক্ষে ৯০০ ইহুদিকে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে আগুণ লাগিয়ে দেয়া হয়। ইহুদিরা দাবি করে এই ৯০০ জনের প্রত্যেককেই জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলে উন্মত্ত জনতা। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করে পোপ ষষ্ঠ ক্লিমেন্ট দ্রুততার সঙ্গে বুল তথা তার মতামত জারি করতে বাধ্য হন। তিনি পুরো ইউরোপের অসহায় ইহুদিদের উপর খ্রিস্টানদের এই উন্মত্ততার প্রতিবাদ জানিয়ে তা অবিলম্বে বন্ধ করার আহবান জানান। পাশাপাশি তিনি এও ঘোষণা করেন যে ‘খ্রিস্টানদের কৃতকর্মে মহান স্রষ্টা তাদের উপর রুষ্ট হয়েছেন, ফলে এই রোগ গজব হিসেবে নাজিল হয়েছে’।
পাদটীকা: করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর ভারতের দিল্লিতে নিযামুদ্দিনের তাবলীগ জামায়াতের লোকজনকে যেভাবে বলির পাঁঠা বানানো হচ্ছে সেটা লজ্জাজনক। একইভাবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে স্বামীবাগের ইসকন মন্দিরে করোনা ছড়িয়ে পড়া নিয়ে সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করার কোনো সুযোগ নাই। একইভাবে ইসলামোফোবিয়াকে পুঁজি করে যারা নানা রকম উস্কানি ছড়াচ্ছে তাদের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখা উচিত মহামারী শুরু হলে বৈশ্বিক পরিসরে নানা অস্বাভাবিক আচরণের নমুনা বর্তমান কালে তো বটেও ঐতিহাসিক পরিসরেও দৃশ্যমান। এইসব অস্বাভাবিকতা, গুজব ও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে টিকে থাকাটাই সমাজের সৌন্দর্য। এখানে চিন্তাটা হতে হবে ইনক্লুসিভ, অবশ্যই এক্সক্লুডিং নয়। মনে রাখা উচিত যে কারও ছড়ানো গুজব ও সাম্প্রদায়িকতার বলি হতে পারে একজন অসহায় মানুষ।