সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ দেখতে এখন আর দৈনিক পত্রিকাগুলোর পাতা উল্টাতে হয় না, প্রথম পাতাতেই বেশির ভাগ দিনে চোখে পড়ছে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল কীভাবে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এখানে দেশের অন্যসব সমস্যার মতো এক ধরনের মুখস্থ প্রতিবেদন লিখতে দেখা যায় প্রতিবেদকদের। তারা চিন্তার সময় পাচ্ছেন না তেমন। কারণ প্রতিদিন এক সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, এটা তাদের কাছে আর কিছুই না, নিছক একটা ঘটনামাত্র। তাদের হিসাব অনেকটা এমন যে, ‘একজন মানুষ মারা গেলে সেটা মহাশোক, দুজন মরলে সেটা শোক আর এর পর থেকে সেগুলো নিছক ঘটনা আর এর থেকে বেশি হয়ে গেছে— তা নিছক পরিসংখ্যানের বাইরে আর কিছু না’। এক্ষেত্রে পরিসংখ্যাটা উল্লেখ করা যেতেই পারে। ৪ জুলাই, মঙ্গলবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি এক সংবাদ সম্মেলনে ‘ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনা প্রতিবেদন-২০১৭’ তুলে ধরে। সেখানে দেখা যায়, ‘এবারের ঈদযাত্রার ১৩ দিনে দেশে সড়ক, রেল ও নৌপথে ২৪০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৩১১ জন নিহত। আহত হয়েছেন ৮৬২ জন। এর মধ্যে ২০৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৭৪ জন নিহত ও ৮৪৮ জন আহত হয়েছেন।’
জম্মু কিংবা আজাদ কাশ্মীরে একজন মানুষের প্রাণহানি, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সীমান্তে গুলিবর্ষণে বেসামরিক মানুষের মৃত্যু, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের গুলিবর্ষণ ও বাংলাদেশী হত্যা, ভারতীয় কিংবা পাকিস্তানি বাহিনীর লাইন অব কন্ট্রোল অতিক্রম করা কিংবা বিশেষ টপিকে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেফাঁস মন্তব্য— এগুলো যেমন চিরপরিচিত ও স্বাভাবিক ঘটনা। বিশ্বের গণমাধ্যম এগুলোকে এখন যেভাবে নিচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনা ধীরে ধীরে সেই অবস্থানে উপনীত হয়েছে। দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সার হয়ে গেলে যেমন সবাই মনে করে মৃত্যু অবধারিত, তেমনি আমাদের দেশের মানুষ এখন ভাবতে শুরু করেছে পথে নামলে মৃত্যু আসতেই পারে। এক্ষেত্রে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে যেমন বাঁচিয়ে তোলার জন্য বিভিন্ন ধরনের রে দেয়া হয়। এটাতে কতজন রোগী বেঁচে ওঠেন তার ঠিক নেই, তবে তা চলছে বেশ ভালোই। বলতে গেলে এই রে প্রদানে ক্যান্সারের চিকিত্সা যেমন জনপ্রিয়; বর্ষা মৌসুমে খোয়া-বালি-সুড়কি ঢেলে ক্যান্সার আক্রান্ত সড়ক মেরামতের হাস্যকর প্রচেষ্টাটাও ঠিক তেমনি।
বাংলাদেশের সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মসংক্রান্ত টেন্ডারগুলো যে ঠিকাদারগণ গ্রহণ করেন, উনারা বোধ করি অতিরাবিন্দ্রিক। তাঁরা কবিগুরুর কবিতার ছন্দে ছন্দে কাজ করেন। কবিগুরু যেমন লিখেছেন, ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।’ আমাদের বড্ড রসিক ঠিকাদাররা এর উল্টোপথে-উল্টোরথে চলাটাকেই ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। ঠিক যখনি ‘বাদলের ধারা ঝরে ঝরো-ঝরো, পথ-ঘাট জলে ভরো-ভরো’। সম্বিত ফিরে পান তাঁরা, হেঁকে বসেন ‘এসো ভাই ধরো সবাই, কোদাল গাঁইতি ধরো, যেখানে যেভাবে পারো, রাস্তাগুলো খুঁড়ো; যা-ই হোক না হায়, তাতে কি এসে যায়, ভাসিয়ে দেব দেশ এবার, উন্নয়নের বন্যায়।’ অনেকটা শ্লেষাত্মক কিংবা ব্যঙ্গবিদ্রুপের সুরে বলা উপরের লাইনগুলো কতটা নির্মম বাস্তব, সেটা ঢাকাবাসী তো বটেই অনেক মফস্বলের অধিবাসী এখন হাড়ে হাড়ে জানেন। তাই ঐতিহাসিক যুগের রণাঙ্গন আর এখনকার বাংলাদেশের রাস্তাগুলো এক; এখানে ধীরে কিংবা আস্তে, নতুন কিংবা পুরনো যে গাড়ি যেভাবেই চলুক, অন্তত মানুষ মরবেই।
বাগদাদ দখলের পর হালাকু খানের সেনাদল কতজন মানুষ মেরেছে, পানিপথের তিন তিনটি যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা কত, হিটলারের নাজি বাহিনী কতজনকে হত্যা করেছে কিংবা লাইন অব কন্ট্রোলে কয় রাউন্ড গুলি চলেছে, এগুলোর হিসাব চাওয়াটা যেমন নিরর্থক, তেমনি গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের নানা স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় কতজন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, তার সঠিক হিসাব নেই কারো কাছে। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা অসমর্থিত সূত্র থেকে তাদের মতো সংবাদ ছাপছে। এখানে কেউ কেউ সুন্দর করে গ্রাফ তৈরি করে নজর কাড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সময়ের আবর্তে মৃত্যুফাঁদে রূপ নেয়া মর্মন্তুদ মহাসড়কে যে মানব মড়ক, প্রাণহানির যে পাগলা ঘোড়া, তার লাগাম টানতে ব্যর্থ হচ্ছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। গত প্রায় এক যুগে এহেন অপরিবর্তিত পরিস্থিতি আর লাগাতার প্রাণহানির দায় তাই পুরোটাই সরকারের ওপর বর্তায়। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাফল্য, দেশ ডিজিটালকরণ, জিডিপিসহ আর্থিক খাতে নানামুখী উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রায় সাফল্য, মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে ওঠা কিংবা ধীরে ধীরে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের চেষ্টা— এসবই ব্যর্থ বলে প্রমাণিত, যখন রাষ্ট্র তার রাজপথে নাগরিককে নিরাপত্তা দিতে পারছে না।
ফি বছর মৃত্যুর এ পরিসংখ্যান উল্লেখ করে দেশের বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ কিংবা সাংবাদিক সবাই কমবেশি লিখেছেন, বলেছেন ও বলে যাবেন। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র বদল ঘটেনি পরিস্থিতির। বরং সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনার যে হিংস্র অবয়ব, সেটাকে আর দুর্ঘটনা বলার সুযোগ নেই। এটাকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বৃত্তায়ন ও নির্মাণকাজ অবনমনের বিপরীতে এক ধরনের ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ম্যাস কিলিং’ তথা ‘অবকাঠামো দুর্বলতাজনিত গণহত্যা’ বলাই শ্রেয়। বিশেষ করে আজ থেকে কয়েক বছর আগেই একটি গবেষক দল দেখিয়েছেন, ‘মহাসড়কের নির্মাণত্রুটি দূর করার মধ্য দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব। নানা উদাহরণ দিয়ে সেটাকে প্রমাণ করা হলেও বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তরফ হতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, একমাত্র ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ১১টি স্থানে বিদ্যমান বাঁক প্রশস্ত করার পর ওই এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কল্পনাতীতভাবে কমে যায়। এটা বাইরের কোনো গবেষক দলের দেয়া তথ্য নয়, বরং এ তথ্য সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তরফ থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়েছিল ২০১৪ সালের দিকে। তবে এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, একই উদ্যোগ পুরো দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়কে নেয়া হলে সেখানেও দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা কমতে পারত। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণে তেমন তত্পরতা লক্ষ করা যায়নি।
আমরা জানি, বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা ইনস্টিটিউট দেশজুড়ে ৩ হাজার ৫৮০ কিলোমিটার মহাসড়কের ২০৯টি স্থানকে অতি-দুর্ঘটনাপ্রবণ ‘ব্ল্যাক স্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। গাণিতিক হিসাবে দেশের মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৫ শতাংশ এবং মোট মৃত্যুর ৯০ শতাংশ দীর্ঘদিন থেকে ঘটে চলেছে এই নির্দিষ্ট স্থানগুলোয়। পুরো দেশের মোট মহাসড়কের মাত্র ৫৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ ‘ব্ল্যাক স্পট’গুলো ছড়িয়ে থাকার কথা নির্দিষ্ট করেছিলেন বুয়েটের ওই গবেষক দল। সেখানে সরু বাঁক থেকে শুরু করে যে ধরনের নির্মাণ প্রকৌশলগত ত্রুটি চিহ্নিত করা হয়েছিল, তার থেকে উত্তরণ ঘটানো গেলেও অন্তত প্রাণহানির সংখ্যা অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। এই ব্ল্যাক স্পট বাদ দিলে নানা স্থানে অবৈধ হাটবাজার, বাসস্ট্যান্ড ও অন্যান্য স্থাপনা রয়েছে দীর্ঘদিন থেকেই। সেখানে উপযুক্ত লোকসমাগম ঘটলেও প্রয়োজনীয় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি কয়েক যুগ ধরে।
প্রস্তাবের পর প্রস্তাব আসছে। একের পর এক সেমিনার-সিম্পোজিয়াম শেষ হচ্ছে। গ্যালন গ্যালন মিনারেল ওয়াটারের বোতল খালি করে মুখে বক্তব্যের ফেনা তুলছেন বিশেষজ্ঞরা; মিটিং টেবিলে বসে প্যাকেটের পর প্যাকেট নাশতা শেষ করে শেষ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তই দিতে পারছেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অনেক হর্তাকর্তা। এদিকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে লাশের মিছিল, দিনের পর দিন রাস্তার নানা স্থানে গর্তের সংখ্যা বাড়ছে। পানি জমে থাকা অচল সড়কে ভাগ্য সহায় হলে কোথাও কোথাও পড়ছে দু-এক পিকআপ রাবিশ ইট কিংবা পাথরের কুচি। কিছুক্ষণ বাতাসে রাখলে কর্পূর যেমন মিলিয়ে যায়, বৃষ্টির দিনে কাচের জানালার শার্সিতে জমা পানির ধারা যেমন হুট করেই শুকিয়ে যায়; তেমনি যানবাহনের চাকার চাপেই হারিয়ে যাচ্ছে এগুলো। ফলে সড়কের গর্ত কিংবা জলাবদ্ধ স্থানগুলো বছরের পর বছর ধরে রয়ে যাচ্ছে একই রকম, অভিন্ন ধারায় সেখানে ঘটে চলেছে দুর্ঘটনা আর মরছে মানুষ।
লজ্জাজনক হলেও সত্য, কেবল চালকদের বেপরোয়া গতির ধুয়ো তুলে সবাই দুর্ঘটনার অন্যসব কারণকে আড়াল করতে চান। কিন্তু ‘শাক দিয়ে যেমন মাছ ঢাকা’ যায় না, তেমনি কথিত এসব বিশেষজ্ঞের মনে রাখা উচিত, বিগত ‘রিও ডি জেনিরো’ অলিম্পিকে একজন সাইকেল আরোহী যে গতিতে তার দ্বিচক্রযান চালিয়ে তৃতীয় পুরস্কার জিতেছেন, তার থেকেও শ্লথগতিতে চলছে আমাদের দেশের দূরপাল্লার যানবাহনগুলো। তাই চালকদের সতর্ক করা কিংবা শাস্তির সম্মুখীন করলে কিছু হবে না। অন্যদিকে শুধু রাস্তার প্রয়োজনীয় সংস্কার করা গেলে কমিয়ে আনা নয়, শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব এ দুর্ঘটনা আর হতাহতের সংখ্যা। মহাসড়কের ত্রুটিজনিত এ ক্রমিক দুর্ঘটনা ও ‘সিলিয়াল কিলিংয়ের’ আদলে ঘটতে থাকা পৌনঃপুনিক প্রাণহানি কমানোর উপায় বের করতে তাই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেই। যে যা-ই বলুক, সড়ক সংস্কার ও তার উপযুক্ত পুনর্নির্মাণের কাজে সরকারের সক্রিয় না হলে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও র্যালি করে এ ধরনের দুর্ঘটনা বন্ধ করা দূরে থাক, হ্রাসকরণও সম্ভব নয়। নিরাপদ সড়ক স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের অধিকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত, সবার আগে উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে জনগণের এ অধিকার বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়া।