দেখতে দেখতে প্রায় শেষ হয়ে এল একটি বছর ২০১৭। নতুন বছর ২০১৮কে স্বাগত জানানোর নানা প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। অর্জন-বর্জনের খেরোখাতায় উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল নানা বিষয় হয়েছে ভাস্বর। অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবলে আমাদের মেয়েদের অভাবনীয় সাফল্য যেমন নতুন বছরে সবাইকে প্রাণিত করবে, তেমনি ঘুরে-ফিরে আসছে নির্বাচন প্রসঙ্গটি। আসলে নির্বাচন বলতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের শূন্যস্থান পূরণের আসন্ন প্রচেষ্টাকেই বুঝবেন সবাই। তবে শতখবরের অন্তরালে রয়ে গেছে আরেকটি নির্বাচনের খবর। দীর্ঘদিন পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট নির্বাচন হতে যাচ্ছে, যা দেখে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে গ্র্যাজুয়েটরা বেশ উদ্দীপ্ত। অনেক যোগ্য গ্র্যাজুয়েট এখানে প্রার্থী হয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে এখানকার ছাত্র-শিক্ষক নির্বিশেষে সবার জন্যই আনন্দের। সবচেয়ে বড় কথা, বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অকার্যকর ছাত্র সংসদগুলোর সামনে জমে ওঠা আগাছা বড় হতে হতে প্রায় ছোটখাটো বনাঞ্চলে রূপ নিচ্ছে। সেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক চিন্তার সমাধি রচিত হয়ে গেছে বলেই মনে করা হচ্ছে একটি সময় থেকে। এমনি একটি পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে স্বতঃস্ফূর্ত সিনেট নির্বাচন নিঃসন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য আশাপ্রদ একটি ঘটনা।
আমরা দেখেছি, রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট হিসেবে অনেকেই নিজেকে প্রমাণ করতে চাইছেন। শিক্ষক, সাবেক শিক্ষার্থী, উচ্চপদস্থ আমলা, সরকারি চাকুরে, উদ্যোক্তা, শিল্পপতি কিংবা রাজনৈতিক পদ উপেক্ষা করে সবাই প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কিছু একটা করবেন— এমন প্রতিশ্রুতি রেখে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইছেন। ক্যাম্পাসের আশপাশে কিংবা ভেতরে ঘুরে দেখলে অনেকটা ট্রাক কিংবা মিনিবাস মালিক সমিতির নির্বাচনের মতো পোস্টার-ব্যানারে ছেয়ে গেছে। এ বিষয়টা নিয়ে যারা হাস্যরসের জন্ম দিচ্ছেন কিংবা ট্রল করছেন, তাদের বিপক্ষে বলার কিছু না থাকলেও সতর্ক করা যায়। অন্তত এ মর্মে তাদের থামিয়ে দেয়া যেতে পারে যে, যা-ই হোক, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার বিকাশ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা ও নৈতিক চিন্তার প্রতিষ্ঠান যখন গণতান্ত্রিক মনোবৃত্তির আশ্রয়স্থল হবে, তা নিঃসন্দেহে দেশকে এগিয়ে নেবে অনেক দূর।
অদ্ভুত ব্যাপার হিসেবে এ গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্যে অগণতান্ত্রিক অচ্ছুত আচরণও লক্ষ করা গেছে। বিশেষ করে, বিশেষ প্রার্থীর আজ্ঞাবহ কেউ কেউ আলাদা রকম ‘সচেতনতার’ প্রকাশ ঘটাচ্ছেন অনলাইন কিংবা অফলাইনে। লজ্জার মাথা খেয়ে নানা প্রার্থী নিয়ে চলছে নানা ধরনের অপপ্রচার ও বিষোদ্গার। সত্যি বলতে সাধারণ শিক্ষার্থী, গ্র্যাজুয়েট এবং শুভার্থীরা এটা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের এমন নির্বাচন আর যা-ই হোক, মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচন নয়। এখানে কে কাকে ভোট দেবেন, কীভাবে দেবেন, কেনই বা তিনি বিশেষ প্রার্থীকে বেছে নেবেন, এটা নিছক তার ব্যক্তিগত। এক্ষেত্রে অহেতুক বিষোদ্গার কিংবা অতিরিক্ত সতর্কতার বাণী নিঃসন্দেহে নিম্ন মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ। তবে কিছু বিষয় নিয়ে এগুলো কি তাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতার প্রকাশ না কোনো প্যানেলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের সূক্ষ্ম কৌশল, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। বক্তব্যগুলো এমন— ক. বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যুক্ত রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটদের বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থাকা গ্র্যাজুয়েট প্রার্থীদের পাস করিয়ে আনাটা জরুরি। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি হবে, খ. শিক্ষকদের যেহেতু ৩৩টি সিনেট পদে আসার সুযোগ আছে, তাই এই ২৫ রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট সদস্যের জায়গায় তাদের আসা উচিত নয়। এ ধরনের প্রশ্ন উঠলে একটা প্রশ্ন করাই যেতে পারে যে, শিক্ষক হিসেবে যারা কর্মরত, তারা কি একটা সময় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন না। তারা কি এখন এখানকার রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট নন। এ ধরনের প্রশ্নগুলো আসলে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে একটা প্রতিবন্ধক হয়ে উঠবে শুধু। এদিকে এ ধরনের চিন্তা করলে তা নির্বাচনের পরিবেশকেও বিপন্ন করতে পারে। তবে যারা এ ধরনের কথা প্রচার করছেন, সাধারণ রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটরা জানেন না যে, এরা কতটা ভেবে এসব বলছেন কিংবা লিখছেন।
প্রত্যেকেই কমবেশি জানেন ও বোঝেন জাকসু নির্বাচন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট নির্বাচন আর সিনেট নির্বাচন ও কর্মপদ্ধতি এক নয়। শিক্ষক, কর্মকর্তা নিয়োগ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সব গুরুত্বপূর্ণ কাজের অনুমোদন আসে সিন্ডিকেট থেকে। সে দিক থেকে সিনেটের কর্মপরিধি সীমিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। সিনেটররা ভিসি নির্বাচন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট পাস, গুরুত্বপূর্ণ সংবিধি প্রণয়ন, আইন পাস বা সংশোধন এবং ছাত্রকল্যাণমূলক অল্পবিস্তর কিছু কাজে সাধারণ ভূমিকা রাখেন। এদিক থেকে ধরতে গেলে সিনেটের গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। বরং এখানে এমন সব প্রার্থীর আসা উচিত, যারা নিজ কর্মস্থলে যোগ্যতা, সততা ও আন্তরিকতার পরিচয় রেখে সফলতা অর্জন করেছেন। অন্যদিকে এখানে সেসব প্রার্থীরই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা উচিত, যারা ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর স্বার্থ থেকে নিজ ক্যাম্পাস ও পূর্বতন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গৌরব সমুন্নতকরণে একাত্ম। সেদিক থেকে চিন্তা করলে এ সিনেট নির্বাচনকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
একজন ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে বলতে পারি, এ সিনেটের ধারণা সর্বপ্রথম বিকাশ লাভ করেছিল প্রাচীন রোম সভ্যতায়। সেখানেও রাষ্ট্র পরিচালনায় নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল সিনেটরদের। রোমে বয়োজ্যেষ্ঠ অভিজ্ঞদেরই সিনেটর করা হতো। তারা নানা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নিজ অভিজ্ঞতা থেকে পরামর্শ নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে সহায়তা করতেন। এক্ষেত্রে আমাদের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটরদের যে ধরনের দায়িত্ব থাকে, তাতে অভিজ্ঞতার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। অবশ্য এটিও ঠিক, অভিজ্ঞতা সবসময় বয়সের হিসাবে হয় না। তবে যোগ্যতা ও দক্ষতার দিক থেকে দেখলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোনোভাবেই ২৫ জন সিনেটরের অবস্থানে দাঁড়াতে পারবেন না— এটা মনে করার সুযোগ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, প্রপাগান্ডা ও বিভাজনের রাজনীতি শুরু হলে বোঝা যায় একটি নির্বাচন কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর তাই গুরুত্বপূর্ণ এ নির্বাচনে প্রকৃত প্রাজ্ঞ— যারা সিনেটে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবেন, শুধু শিক্ষক পরিচয়ের কারণে তাদের সিনেটে আসার পথ বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। অন্যদিকে, অতীতে শিক্ষকদের থেকে হওয়া সিনেটরদের কাছে নানা দাবি উত্থাপন করলে তারা মুখ ফিরিয়ে ছিলেন এমন নয়। পাশাপাশি অতীতের সিনেটে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে অনেক সিনেটর ছিলেন, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নন। তারা কী কী সাফল্য অর্জন করেছেন, এটাও এক্ষেত্রে স্পষ্ট নয়। তবে ৩৩ জন শিক্ষক সিনেটরের কথা তুলে তৈরি করা অস্পষ্টতার সুরাহা হওয়া প্রয়োজন আরো আগে। প্রথমত. এ ৩৩ সিনেট সদস্য কোটায় জাহাঙ্গীরনগর থেকে পাস করে বের হওয়া শিক্ষার্থী থেকে শিক্ষক হয়েছেন, এমন বাদেও যেকোনো শিক্ষক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।
অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহভাগ প্রভাবশালী শিক্ষক এখন কঠিনভাবে রাজনৈতিক দলভুক্ত। প্রায় ৯০ শতাংশ প্রার্থীর মতো অনেক শিক্ষকও মুক্তচিন্তার নন, প্রার্থীর যোগ্যতায় নয়, দলীয় প্যানেলেই ভোট দিতে চাইবেন। সেখানে নির্দলীয় মুক্তচিন্তার শিক্ষক— যাদের সিনেটর হিসেবে দেখতে চাই, তারা কখনো শিক্ষক কোটায় নির্বাচন করে পাস করবেন না। ফলে তারা শিক্ষক ভোটের জায়গাগুলোয় সাধারণত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন না। তাহলে এসব যোগ্য, প্রাজ্ঞা ও সম্মানিত শিক্ষকরা যাবেন কোথায়? একটু খেয়াল করে দেখলে, তাদের একমাত্র সুযোগ এই ২৫ রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটের জায়গা থেকে প্রার্থী হওয়া। সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের এমন নির্বাচনে রাজনীতি কিংবা ব্যক্তি স্বার্থের বদ্ধ চিন্তায় আটকে থাকার সুযোগ নেই। প্রত্যেক প্রার্থীর মতো সম্মানিত ভোটাররা অবশ্যই তার পছন্দসই প্রার্থী বেছে নেয়ার সক্ষমতা রাখেন। এক্ষেত্রে যারা সিনেটর হয়ে নিজ যোগ্যতা, সক্ষমতা, আন্তরিকতা, প্রজ্ঞা ও মেধা সামনে রেখে উপযুক্ত ও যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, তাদের পক্ষেই রায় দেবেন সবাই। আর সেটা হলে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও এগিয়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। ২০১৭ সালের ঠিক প্রান্তিকে এসে হতে যাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগরের এ নির্বাচন। সবাই নিজ নিজ ভোটাধিকার প্রয়োগে প্রিয় ক্যাম্পাসে যথাসময়ে উপস্থিত হবেন— এমন আশা রাখাই যায়। অন্তত এ শশব্যস্ত সময়ের সালতামামি বাদ দিয়ে একটা সাধারণ নির্বাচন নিয়ে এর চেয়ে বেশি বলার কিছু নেই।