এবারের দীর্ঘায়িত শীতকালের রেশ সরে যেতে না-যেতেই হুট করে চলে এল বসন্ত। কালবৈশাখীর উন্মাদ তাণ্ডবে মানুষ এবার ঋতু বসন্তের সৌন্দর্যের চেয়ে রোগ বসন্তের দুর্ভোগের কথাই স্মরণ করছে বেশি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভাষ্যে, এ দাবদাহ দীর্ঘায়িত হতে পারে অনেকদিন। উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়ার দেশ বাংলাদেশে পরিবেশের কারণেই প্রায় প্রত্যেকেরই শরীর থেকে ঝরছে ঘাম। এ ঘামের সঙ্গে সঙ্গে শরীর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে প্রচুর পানি এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও ইলেকট্রোলাইডস। সবার মনে এই বের হয়ে যাওয়া বাড়তি পানির চাহিদা পূরণের একটা তাগিদ থাকে। ফলে ফরমালিন কিংবা কেমিক্যালের ধার না ধেরে সবাই ঝুঁকছেন তরমুজ, বেল, পেঁপে, লেবু, আনারস, কাঁচা আম, জলপাই, আমড়া এমনকি আমলকীর শরবতের দিকে। পাশাপাশি সমানভাবে গুরুত্ব বেড়েছে বিভিন্ন মৌসুমি ফলের। এ মৌসুমে ক্রেতারা দেশী ফলের দিকে আকৃষ্ট হলে তাতে উপকার হওয়ার কথা চাষীদের। কিন্তু এক্ষেত্রে ঘটনা ঘটছে উল্টো।
সাধারণ ক্রেতাদের ফলের প্রতি অতি আগ্রহ থেকে সুযোগ নিচ্ছেন ফল বিক্রেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন জুস ও শরবতের দোকানিরা। তারা উচ্চমূল্যের ফল কিনে এনে তার ক্রয় উত্তাপ আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়ে বিক্রি করছেন নামমাত্র ফলের উপাদানযুক্ত বিভিন্ন নামের শবরত। আশির দশকে কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। আমার ধারণা কবি এখনকার ফলের জুস ও শরবতের দোকানগুলো ঘুরে এসে তার কাব্যগ্রন্থের নাম দিতে গেলে লিখতেন, ‘যে বরফজলে আগুন জ্বলে’। এ লেখাটির অদ্ভুত শিরোনাম দেয়ার পেছনে মূলত এমন ধারণাই কাজ করেছে। একটি নন্দিত ফাস্টফুডের দোকানে চিকেন ফ্রাই খেয়ে ওঠার পর সঙ্গে থাকা জনৈক সহকর্মীর সুপুত্র হেঁকে বসে, ‘আংকেল জুস খাব’। পিচ্চিকাচ্চাদের বাইরে কোথাও খাওয়ার জন্য নিয়ে গেলে আইসক্রিমের প্রতি যে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ থাকে, সেখানে জুসই ভরসা। যথারীতি অর্ডার দিতে অল্প সময় ব্যবধানে জুস এসে হাজির। ‘স্ট্র দেয়া নেই কেন’—ওয়েটারকে এমন প্রশ্ন করতে যাওয়ার আগেই আমার গুণধর ভাইপো জুসে চুমুক দিয়ে দিয়ে এক নিঃশ্বাসে সাবাড় করে ঠক করে গ্লাসটা টেবিলে রাখল।
যাহোক, একটা সময় অনেক আগ্রহ নিয়ে ‘হাড় কিপটে’ নাটকটা দেখেছিলাম। তাই কী আর করা। আমি বিস্ময় কিংবা বিরক্তি দুটোর মধ্যে কোনো একটা কারণে আড়চোখে গ্লাসের দিকে দৃষ্টি দিলাম। তাকিয়ে চোখ কপালে ওঠার দশা। ‘ওয়াটার মেলন জুস’ নামের যে বস্তুটি অর্ডার দেয়া হয়েছিল, গ্লাসের উপরিভাগের সিকি অংশেই ছিল তার সগৌরব উপস্থিতি; যা আমার ভাইপো এক ঢোকে পেটে চালান করে দিয়েছে। পরম বিরক্তি নিয়ে লক্ষ করলাম, গ্লাসের ভেতর থেকে তখনো বিশ্রীভাবে ভেংচি কাটার মতো উঁকি দিচ্ছে বরফকুচির স্তূপ। মনে একটা দুশ্চিন্তার মেঘ তখন ঘিরে ধরছে চারপাশ থেকে। আমার সপ্তম ইন্দ্রিয় থেকে একটা ইঙ্গিত আসছে, ‘এ বরফকুচি ঢাকার কোনো মেছোঘাটায় তৈরি সুপেয় বুড়িগঙ্গার জলের জমাটবদ্ধ রূপ নয়তো!’ মন থেকে অশুভ ভাবনা দূর করতে নাকি ওঠার তাড়া থেকে মনে নেই, ওয়েটারকে হেঁকে বসলাম বিলের জন্য। সে কুিসত একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘স্যার ১ হাজার ৬৮০ টাকা + ভ্যাট।’ আমি তার বক্তব্যে কান না পেতে দৃষ্টি দিলাম বিলের দিকে। বিশেষ করে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড় কথিত ‘ওয়াটার মেলন জুস’ বাবদ তার ৩১০ টাকা বিল করতে দেখে। অসহায়ের মতো চারপাশে একটা দৃষ্টি দিয়ে আস্তে করে বিলটা রেখে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল সেদিন।
কাচঘেরা ঠাণ্ডা ঘর থেকে সোজা এবার রাজপথের পাশে এক ফুটপাতে। মিরপুর ১১ নম্বর কেএফসি থেকে বোর্ড বাজার গাজীপুরে খালেক চাচার দোকান কতদূর? অনেক ঘটনার পর যেমন নিজেকে মাফ করতে পারিনি, তেমনি এ দূরত্ব পরিমাপেরও সাধ্য নেই আমার। এখানে এসে দরদর করে ঘামতে থাকা দোকানির স্বল্প বিরতিতে কষে হাঁচি দেয়ার পাশাপাশি নাক থেকে শ্লেষ্মা ঝরতে দেখে তার থেকে জুস কিনে খাওয়ার মতো বিপ্লব ঘটাতে পারিনি। ছোটলোক মধ্যবিত্তের করুণ চাহনি নিয়ে একটু খেয়াল করলাম, তার থেকে অনেকটা লাইনে দাঁড়িয়ে জুস কিনে অবলীলায় পেটে চালান করছেন অনেকে। আমি ধীরে সুস্থে রিকশা থেকে নেমে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম ওই জুসের দোকানের পাশের টি-স্টলে। আমি যে রিকশায় করে যাচ্ছিলাম, তার চালককেও এক কাপ চা অফার করলাম। এ রিকশাচালক আমার আগে থেকে পরিচিত। সে চায়ের বদলে জুস খাওয়ার আবদার করে বসল। আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম এর নোংরা অবস্থার কথা। শেষ পর্যন্ত তার দাবির কাছে নতিস্বীকার করলাম। যথারীতি এবারো বিল দিতে গিয়ে অবাক। এক গ্লাস আনারসের জুসের দাম হাঁকা হচ্ছে ৫০ টাকা। আমি দোকানির দুরবস্থার সঙ্গে সঙ্গে এটাও খুব সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল করেছিলাম যে, মাত্র এক-দুই টুকরা আনারস দিয়ে চিনি-স্যাকারিনের অদ্ভুত মিশ্রণসহযোগে তৈরি করা হচ্ছে এ জুস। ‘বাংলাদেশে ক্রেতা ও ভোক্তাদের কেন অধিকার থাকতে নেই’—এ মর্মবাণী মনে মনে আওড়ে সেখান থেকে সেদিনও নিভৃতে সরে এসেছিলাম।
ঘটনাস্থল এবার এয়ারপোর্ট রেলওয়ে স্টেশন। সড়কপথের ভয়াবহ যানজট থেকে নিষ্কৃতিপ্রাপ্তির ব্যর্থ উচ্চাশায় জয়দেবপুর থেকে ট্রেনে চেপে গলদ্ঘর্ম হয়ে নামলাম এয়ারপোর্ট স্টেশনে। গলা শুকিয়ে কাঠ। এগিয়ে গিয়ে স্টেশনসংলগ্ন একটা রেস্টুরেন্ট থেকে মিনারেল ওয়াটার কিনতে চাইলে দোকানি বলল ফ্রিজ থেকে বের করে নিতে। বোতলের ঢাকনা খুলে দুই ঢোক গিলে গলা ভেজানোর পর আধা লিটার পানির মূল্য বাবদ চিরাচরিত নিয়মে তার দিকে ১৫ টাকা এগিয়ে দিতেই খ্যাপা কুকুরের মতো খেঁকিয়ে উঠল সে। হুংকার দিয়ে জানাল, ‘আরো ১০ টাকা দিতে হবে।’ অবাক হয়ে পকেট থেকে আরো ১০ টাকা বের করে তার দিকে ঠেলে দিতে দিতে জানতে চাইলাম, ১৫ টাকার পানি কীভাবে ২৫ টাকার সম্মান অর্জন করল? সে তার উত্তরে বলল, এত ফাউ প্যাঁচাল পাড়ার সময় তার নেই। স্টেশনে খরচ বেশি, তাই ১৫ টাকার পানি এমনিতে ২০ টাকায় বিক্রি করা হয়। অন্যদিকে ফ্রিজে রাখলে বিদ্যুতের বিল দিতে হয়, তাই আরো ৫ টাকা মিলিয়ে ১৫ টাকার পানির দাম পড়ে ২৫ টাকা। আশপাশের আরো দু-এক দোকান খুঁজে আবিষ্কার করি, জুস, কোক, ফান্টা, সেভেনআপ, এনার্জি ড্রিংস কিংবা জিরাপানি যে নামেই হোক না কেন, গরম-ঠাণ্ডার মারপ্যাঁচে এমনই আর্থিক দণ্ডের ডাণ্ডা কষা হচ্ছে ভোক্তার ঘাড়ে। সবচেয়ে অবাক হলাম অনেক দোকানে ফ্রিজ থেকে বের করে বিদেশী ড্রিংসের নাম দিয়ে একেকটা ক্যান বিক্রি করা হচ্ছে ৪৫০-৫০০ টাকা পর্যন্ত মূল্যে। অদ্ভুতভাবে সেই সব ড্রিংসের বোতলে দেয়া মেয়াদ অনেক আগেই পার হয়ে গেছে, সে ব্যাপারে প্রশ্ন করেও হুমকি-ধমকির মুখে পড়ছেন অনেক ক্রেতা। একজনকে তো বলতেই শুনলাম, ‘ওই মিয়া, এটা বিদেশী ড্রিংস, এর মেয়াদ হয় না। নিলে নেন, না হলে ভাগেন।’
বাংলায় প্রচলিত অনেক জনপ্রিয় একটা প্রবাদ ‘ছাইচাপা আগুন কখনো দমিয়ে রাখা যায় না’। তেমনি এবারের বৈশাখে বাঙালি প্রত্যক্ষ করেছে ‘বরফের আগুন’। সত্য বলতে, বরফচাপা দেয়া আগুনে দামের ইলিশ কেনা থেকে ক্রেতাদের কেউ নিবৃত্ত করতে পারেনি। তারা একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইলিশ কিনেছেন, অভ্যাস থাক আর না-ই থাক, সেই ইলিশ তেলে ভেজে নিয়ে পান্তাভাতে কাঁচামরিচ ডলে কচকচ করে পেঁয়াজ চিবিয়ে গিলেছেন। তারপর কেউ কেউ বিজয়ের আনন্দে হাওয়া খেতে বের হলেও আমাশয়-উদরাময়কে সঙ্গী করে অনেকের ঠাঁই হয়েছে বিভিন্ন জেনারেল হাসপাতালের বেডে। যা-ই হোক, দেশীয় ফল নিয়ে এমন নিষ্ফল তর্ক করে লাভ নেই। গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝরতে থাকা যন্ত্রণার ঘামের সঙ্গে শরীরের অতিরিক্ত পানি বের হওয়াতেই যত সমস্যা। বেশির ভাগ মানুষ মনে করে, ফলের জুস পান করা গেলে সহজেই পানির তৃষ্ণা মেটে। অন্যদিকে এসব দেশী ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, বিটা ক্যারোটিন, মিনারেল ও নানা ধরনের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ঢালাও প্রচারণা থেকে মানুষের মনে এগুলো বদ্ধমূল ধারণা হিসেবে গেঁথে থাকে। আর সেখান থেকেই সুযোগ গ্রহণ করে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
হতাশার প্রহর অনেক দীর্ঘায়িত মনে হয় তখন, যখন জানা যায় বাংলাদেশে ফল ও ফলজাত খাদ্যের বাজারে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে মোটেও আগ্রহী হচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। আমের মধ্যেই ব্যবসা সীমিত করে ফেলেছেন অনেক ব্যবসায়ী। পক্ষান্তরে ফলজাত খাদ্যের দেশীয় উৎপাদনে এগিয়ে না এসে তারা কয়েক গুণ বেশি দামে এসব খাদ্যপণ্যের কাঁচামাল আমদানি করছেন বিশ্বের নানা দেশ থেকে। এতে ফি-বছর মোটা অংকের আমদানি ব্যয়ের বিপরীতে পচে নষ্ট হচ্ছে বিপুল পরিমাণ খাওয়ার উপযোগী সুস্বাদু দেশী ফল। এতে বাধ্য হয়েই বেশির ভাগ কারখানায় ফলের জুস তৈরি হচ্ছে আমদানিকৃত বিদেশী পাল্প দিয়ে। খেয়াল করলে দেখা যায়, স্থানীয় বাজার তো বটেই, আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ চাহিদা রয়েছে এমন বাংলাদেশী ফলের সংখ্যা কম নয়। তবে সেগুলো বছরজুড়ে পাওয়া যায় না। এ ধরনের ফল থেকে যদি জুস, জেলি, সস, আচার বা ফলজাত অন্য কোনো খাবার তৈরি করা যেত, তবে তা বাজারের ওপর থেকে চাপ কমাতে পারত। অন্যদিকে আমদানিনির্ভরতা কমলে অন্তত গ্লাসভর্তি বরফকুচির সঙ্গে নামমাত্র ফলের রস দিয়ে তৈরি জুস এত উচ্চমূল্যে পান করতে হতো না। এ সংকট থেকে উত্তরণে আমাদের উদ্যোক্তাদের সদিচ্ছার পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার বিকল্প নেই। তবে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও দোকানে মিনারেল ওয়াটার থেকে পানযোগ্য তরলের মূল্যবৃদ্ধিতে যেসব অসাধু ব্যবসায়ী জড়িত, তাদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনার বিকল্প নেই। অন্তত এদের দমন করা না গেলে একটা সময় বাংলাদেশের মানুষ মনে করবে তাদের অভিধানে ‘ভোক্তা অধিকার’ বলে কোনো শব্দ নেই।