তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। বইমেলাতে এলাম। কত লেখকের কত গল্প। শিশুতোষ নানা বই আর কিশোর উপন্যাস নিয়ে সহপাঠীদের মাতামাতি। আমি ছিলাম ভিন্ন পথের যাত্রী। ক্লাস থ্রি-ফোরে যখন সবার বইপড়ার হাতেখড়ি হয় ভূতপ্রেতের গল্প দিয়ে, আমার পাঠক মনে কোনো ভূতের আছর ছিল না। ভূত, প্রেত আর অশরীরি বলতে যা বোঝায় তা এক ঐ ব্রাম স্ট্রোকারের ড্রাকুলাতেই সীমাবদ্ধ। অজ পাড়াগাঁয়ের বাউল্ডুলে জীবন হলে য হয়। সবাই যেখানে ড্রাকুলার ভয়ে চুপসে যায়। আমি সেখানে হাতে গোলাপের ডাল আর পকেটে রসুন নিয়ে ঘুরতাম ড্রাকুলা শিকারের আশায়। এসময় বইমেলায় গিয়েছিলাম ছোট চাচার সঙ্গে, চাচা বললেন চল তোকে রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা কিনে দেই। আমি বললাম সবতো পড়া প্রায় শেষ। যেগুলা এখন পাওয়া যায় তেমন ভাল লাগে না, যদি বই কিনতে হয় আমার হুমায়ূন আহমেদই চাই।
সেদিন হরতাল ছিল। রিকশা ছাড়া তেমন কোনো বাহন চলছে না। কলাবাগান থেকে অনেকটা পায়ে হেঁটেই বইমেলা পর্যন্ত চলে গেলাম। বইমেলাতে তেমন ভিড় ভাট্টা নেই। চাচার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় গেলাম। উনি আগ্রহ নিয়ে জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছিলাম। আমার তেমন আগ্রহ জন্মায় নি। উল্টো প্রশ্ন করলাম এই চাদরপরা বিড়িখোর লোকটা কে? সে পলান পাগলের মত বিড়ি ফুকতেছে ক্যান? চাচা ধমক দিয়ে বললেন উনাকে চিনিস! উনি আহমেদ ছফা। আমি উল্টো ভেংচি কেটে বললাম, এত পলান পাগলের দুলাভাই। চাচা কষে ধমক দিলেন দেখে চুপ হয়ে গেলাম।
আহমেদ ছফাকে নিয়ে আর আগ্রহ ছিল না। ভুলে গিয়েছিলাম ওখানেই। কারণ বেশভূষা আর আচরণে আমার তাকে এলাকার পলান পাগল কিংবা গাফফার পাগলের একান্ত আপন মনে হয়েছে। পরে সব চিন্তায় ছেদ পড়লো হুমায়ূন আহমেদকে দেখার পর। চুরি চাট্টা করে তার বই যা কিছু পড়েছি সেগুলা থেকে লেখক কেমন সেটা চিন্তা করার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু সেদিন তার স্টলের সামনে অমন ভিড় দেখে মনে হয়েছিল এটাই বাংলাদেশের সেরা লেখক। নিজে সেরা হতে গেলে এই লেখকের সব বই পড়তে হবে। অদ্ভুতভাবে এর পরবর্তী মাত্র ৫-৭ বছরে হুমায়ূন আহমেদের লেখা সব বই আমার পড়া হয়ে গিয়েছিল।
ঐ ক্লাস ফাইভে থাকতে হঠাৎ ভাবলাম এই লেখক এত লেখা কিভাবে লিখে। অনকের কাছে প্রশ্ন করলাম। এমনকি আমার আব্বা, দাদা এবং ছোট চাচা যার কাছেই প্রশ্ন করেছি সবাই বলেছেন বেশি বেশি পড়ালেকা করতে। তাহলে আমিও একদিন অমন লিখতে পারবো। বিরক্ত হয়ে বললাম আমি এত্ত বই পড়ছি কই আমি তো লিখতে পারছি না। তারপর হঠাৎ একদিন স্বপ্ন দেখলাম একটা টেবিলে হুমায়ূন আহমেদ বসা। পরনে লুঙ্গি, গায়ে স্যান্ডে গেঞ্জি আর অদ্ভুতভাবে তার মাথায় একটা হ্যাট। তিনি হাতে একটা হাতুড়ির মত বড় স্ট্যাম্প নিয়ে একের পর এক কাগজে ছিল মেরে যাচ্ছেন। সেগুলা কুড়িয়ে কুড়িয়ে পাশে থাকা একটা লোক বই হিসেবে বাঁধাই করার জন্য ছাপাখানায় নিয়ে যাচ্ছে।
স্বপ্নের ঘোরেই স্যারকে বললাম; স্যার আমি আপনার সবগুলা বই পড়েছি। এখন নিজে লিখতে চাই। আপনার এই হাতুড়িটা আমাকে দেন। আপনি বুড়ো মানুষ এত স্ট্যাম্প মেরে এত লিখে কি করবেন? স্যার বিরক্ত হয়ে বললেন, যাও দেয়া যাবে না। আমি নাছোড়বান্দা হয়ে বললাম দিতেই হবে। স্যার রাজি হলেন না। আমি বিরক্ত হয়ে বাইরে গিয়ে বিছুটি পাতা এনে স্যারের গায়ে ডলে দিলাম। স্যার রেগে গিয়ে বললেন বেয়াদপ ছোক্রা। দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা। বলে দুম করে হাতের হাতুড়ি দিয়ে আমার মাথায় একটা বাড়ি মেরে দিলেন। ঘুম ভেঙ্গে দেখি আমি খাট থেকে নিচে পড়ে আছি। মেঝেতে বাড়ি লেগে মাথাটা টন টন করছে।
অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে একদিন স্যারকে গল্পটা বলেছিলাম। আর কারও সঙ্গে এই গল্প শেয়ার করা হয়নি। এখন অনেকেই প্রশ্ন করে Sadat Hossain কিভাবে লিখে। আমার মনে হয়, আমি তখন ক্লাস ফাইভে থাকতে যেভাবে ভাবতাম, উনাদের ভাবনার লেভেলটা সেখানেই পড়ে আছে। মাঝে মাঝে মনে হয় উনাদের ধরে অন্দরমহল থেকে বের করে চর কুকরি মুকরিতে নির্বাসন দেয়া উচিত। যাতে করে মেঘেদের দিনে তাদের মন মেঘ ঘনীভূত হয়, চোখ থেকে অশ্রু ঝরে। তারপর আরশিনগরের কোনো বাউল গানের খ্যাপা সুরের টানে পরিচ্ছন্ন হয় তাদের মানবজনম।